চৈত্রের ভয়ংকর সুন্দর দুপুর সবাই উপভোগ করতে পারেনা। যারা পারে তারা অভিশপ্ত!
যারা পারে তারা জীবনে বয়ে বেড়ায় ভয়ংকর সব স্মৃতি, কবিতা, নীলআকাশ, মৃত্যু!
যখন চৈত্রের মাসে নদীতে পানি শুকিয়ে যায়, তৃষ্ণার্থ গাঙ্গচিল চরম পিপাসায় দিগন্তবিস্তৃত তাক লাগিয়ে উড়তে থাকে, যখন চৈতন্য লোপ পেয়ে যাওয়ার মত রোদ্দুর ঝরে পৃথিবীতে, শুষ্ক শশ্মানে চিতার ভষ্ম উড়ে ,সেগুনভরা পাহাড়ে শেষ পাতাটিও ঝড়ে গেছে শক্ত মাটিতে, একটা মাছরাঙা উড়ে যায় ছটফট করতে থাকা সরপুঁটিটির কাছে, এমন ভয়ংকর দুপুর হয়, যখন সবাই একা হয়ে যায়— এসব দৃশ্যপটের সম্মুখীন যারা হয়েছে, যারা উপভোগ করেছে ভীষণভাবে—কি ভীষণ অভিশপ্ত একটা জীবন তারা বয়ে বেড়াচ্ছে অনায়াসে!
আমিতো সেই দুপুরের তৃষ্ণায় ছটফট করে মরে যাচ্ছি ভিতরে ভিতরে একা একা অথচ আমাকে ঘিরে অনেক মানুষ,কেউ বুঝতে পারছেনা।
ঘটে যাওয়া অতীত এত তীব্রভাবে আমাকে আক্রমণ করছে—দুপুর হলেই আমার সারাঘর ভরে যায় গাঙ্গচিল, গাঙ্গচিলের (দুইবার লিখছে সম্ভবত) ডাকে, রোদ্দুর মাখা গরম বাতাসে, দূরের পাহাড় থেকে ঢোলকের করুণ সুরে, অবশিষ্ট খড়ের হলুদ প্রান্তরের একমনে খেয়ে যাওয়া গরুটি—পিপাসায় ডাকছে থেকে থেকে, আমার সারাঘর ভরে যায় আহত এক নীলআকাশে।
গ্রীষ্মের-চৈত্রের দুপুর কিভাবে এভাবে ভয়ংকরভাবে কেটেছে আমার জীবনে একা একা গ্রামে থাকার সময়।
শৈশবে এমন দুপুরে খালে কত ডুব দিয়ে খেলা করেছি মাছেদের সাথে, ছেলেমেয়েদের সাথে,কত বকা খেয়েছি মায়ের হাতে ভরদুপুরে খাল-প্রকৃতি যে প্রায়ই নিসঙ্গ, হিংস্র হয়ে পড়ে। চিংড়িধরা দুপুরে বড় পাথরটার নিচে কত ধরেছি রূপোলী চিংড়ি, সাদা মাছ, সরপুঁটি!
পাহাড় পর্বত ঘুরে খুঁজেছি সবুজ পাখিটি, পানির তৃষ্ণায় তখন গলার মৃত্যু হয়েছিলো, আজ সেই দুপুরের তৃষ্ণায় হৃদয়ের মৃত্যু হলো।
এমন দুপুর, এমন দুপুর— জীবনের সফলতা এমন দুপুর জীবনে পাওয়া, সুনসান এমন দুপুরে পাহাড়ে বিস্তৃত বাতাসে কলাপাতার হুরহুর শব্দ আমাকে দিয়েছি কোটিবছরের শান্তি, সমৃদ্ধতা।কিশোরে এসে জীবনের মধ্যচাপের সময়ে কত কত একা একা এমন দুপুরে মাচারে শুয়ে থেকেছি, শ্যামা পাখিটি এসে ঘুরে যায় আমাকে দেখে ভাবে তার মতো অসুখ বুঝি হয়েছে মানুষটির!খাঁ খাঁ চৈত্রের দুপুরে রোদে পুড়ে পুড়ছি আমি যারা আমরা এভাবে—চিলেদের সাথে,খালের মাছেদের সাথে কিন্তু ছাই হচ্ছি না,আমরা যেন এভাবে হাজার কোটিবছর পুড়তে এসেছি। এমন দুপুরের অভিশাপে পড়েই হয়ত জীবনানন্দ লিখেছিলেন—”একেকটি দুপুর একেকটি জীবন অতিবাহিত হয়ে যায় যেন”!!