আদম

শোয়েব বিন আজিজ

তুমি সেদিন রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাইতেছিলা। তুমি দেখলা কিছু পোলা-মাইয়া রাস্তার বেওয়ারিশ কুত্তা গুলারে খাবার দিতেছে৷ হঠাৎ তোমার চোখ আটকায় গেলো চিকন কইরা এক মাইয়ারে দেখে। নাকটা চিকন, ঠোঁটটা লাল রক্তিম হয়া লেপ্টে আছে লিপস্টিকে। ওই শরীরের পূর্ণ আভা তোমারে জাস্ট মাতাল কইরা দিলো৷

তুমি পতিত হইলা। প্রেমে। যেমনে পতিত হয় মানুষ; মানুষের প্রেমে; যুগ যুগ ধইরা; সিভিলাইজেশনের এক্কেবারে আদি হইতে।

তুমি জানো, মানুষ কেবলই মানুষ হইতে পারে— প্রাণের ঝুঁকি লইবার মধ্য দিয়ে৷ তাই, শত বিপদের আশংকা সত্ত্বেও তুমি আগাইলা, মাইয়াটার পানে । দাঁড়াইলা বুক উঁচু করে। যেনো, মানুষ হিসাবে স্বীকৃতি পাইবার এইটাই তোমার প্রথম স্টেপ।

তারপর কাহিনী সংক্ষিপ্ত কইরা, আমরা চলে যাইতে চাই নিকটস্থ কোনো এক ক্যাফেটেরিয়াতে৷

তুমি আর শে বইসা আছো মুখোমুখি। প্রেম হয় হয় ভাব। কিন্তু এখনও দৃশ্যমান তেমন কিছু ঘটে নাই আসলে। যা কিছু দৃশ্যমান, তা-ই কেবল রিয়েলিটি না। রিয়েলিটিরে কেবল দৃশ্যমানের ভিতরে আটকায় ফেলা যায় না।

তাই, আমরা আন্দাজ করি, তোমার মনের ভিতরে চলিতাছে এখন উথাল-পাতাল। যেই তীব্র শূন্যতা ফীল করতা তুমি সকাল বিকাল— তা যেনো পূর্ণ হইতে চলিতাছে খুব শীঘ্র। তোমার সত্তা হইতে হারায় যাওয়া সেই পিস; সেই খণ্ডাংশ; যারে খুঁজতেছিলা তুমি সারাটা জীবনভর— তারে কি পায়া গেছো তুমি ? এই অবেলায়? ওই মাইয়ার ভিতর?

মাইয়াটারে আরো মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকলা তুমি, প্রতিটা দিন। তার চোখ, নাক, ঠোঁট, বুক, ঘাড়— দেখতে থাকলা তুমি খুটাইয়া খুটাইয়া৷

আর বুঝার চেষ্টা করতেছো তুমি তারে। তার স্বভাবরে। তার চাওয়া পাওয়ারে। তার বাসনা গুলারে। তার মনের দুর্গম অলিগলি গুলারে।

তুমি কি একটু হতাশ হইলা? তারে বুঝতে গিয়া? তার মনের দুর্গম অলি গলি গুলারে খুঁজতে গিয়া? তোমার কি মনে হইতেছে না যে, এই মাইয়া তেমন ডীপ না? মানে, দুনিয়ার মেকানিজম গুলা বুঝবার ব্যাপারটাতে?

আর্ট কালচার তো ঠিকঠাক ভাবে বুঝে টুঝে না এই মাইয়া। লিওনার্দ কোহেনের গানও তো শোনে নাই শে জীবনে। হেগেল, ফ্রয়েড কি জিনিস তা বাকি জীবনভর গুলে খাওয়াইলেও হজম হইবো না তার মগজে।

তো, এমন মাইয়ারে দিয়া কি হবে এই জগত সংসারে? —তুমি ভাবতে থাকলা দিনরাত।

তুমি হতাশ হইলা। কষ্ট পাইলা। প্রতিটা রাত নির্ঘুম কাটায়া দিলা। মাইয়াটারেও ভুইলা যাইতে চাইলা।

আর মনের অলি গলি হতে জীবিত করতে চাইলা তোমার সেই ইন্টেলেকচুয়াল বান্ধবীটারে৷

বান্ধবী কোনোভাবেই চয়েজ হিসাবে মন্দ না! —তুমি ভাবতে থাকলা। কারণ, শে টানা চারঘন্টা মডার্নিজম নিয়ে নির্মম ক্রিটিক করতে পারে৷ শে তো আর্ট কালচার বোঝে৷ তুমি দেখছো, দিস্তার পর দিস্তা পাতা শে রেভ্যুলেশনারী প্যারাগ্রাফ লিখতে জানে।

কিন্তু, মনের ভিতরের খচখচানিটা এখনও প্রশমিত হয় নাই তোমার।

সহানুভূতি আর সহমর্মিতার বিশেষ অভাববোধ খুঁজে পাইছিলা তুমি বান্ধবীর মাঝে৷ তোমার লিমিটেশন গুলারে নিশ্চয়ই বরদাস্ত করবে না শে, তোমার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ভাবাবেগ আর কুঁইকুঁই ঘরকুনো স্বভাবরে নিশ্চয়ই প্রশ্রয় দিতে রাজি হবে না শে। 

ক্লান্ত হইতে থাকলা তুমি ৷ অবসাদ তোমারে ঘিরে ধরতেছে একটু একটু করে৷

তুমি তাকায়া থাকলা বাহিরে। জনস্রোতের পানে। অসংখ্য মাইয়া সর্বস্ব দেহ আর মন গিয়ে মেশে জনস্রোতে। তোমার মনে হইতে থাকে, তাহারা সকলেই তোমার ‘প্রায় হইতে থাকা’ প্রেমিকার চাইতে সুন্দর, যৌন আকর্ষণীয়, ইন্টেলেকচুয়াল, সম্পূর্ণ।

তোমার মনে হইতে থাকে, খোয়া যাওয়া খণ্ডাংশের অভাব এদের যে-কেউই পুরা করতে পারে৷ অর্থাৎ, তোমারে সম্পূর্ণ করতে পারে।

কিন্তু এইগুলা তো ফালতু আলাপ। তুমি জানো। বুঝো। সকল মাইয়ারে তুমি প্রেমিকা বানাইতে পারবা না। প্রাকটিক্যালি পসিবল না। সকলের ভিতরে কেউ একজনরে প্রেমিকা বানাইলে— অন্য আরও আরও অসংখ্য মাইয়ারে কেনো খারিজ করা হইলো? কোন লজিকে? কোন গ্রাউন্ডে? তাইলে কি এইটা শ্রেফ র‍্যান্ডম চয়েজের মামলাতে পরিণত হইলো?

পুরাপুরি ডিগবাজি মারলা তুমি। চিন্তার লাইনে। এতোক্ষণে উপলব্ধিতে আসলো তোমার— সত্তার হারায় যাওয়া খণ্ডাংশ, আসলে তো হারায়েই যায় নাই কখনও। যা কখনও ‘আছিলো-ই না’ – তা কেমনে হারায় যাইতে পারে? হারায় যাইতে হলে তো প্রথমে সেই জিনিসটা থাকতে হয়, নাকি?

তুমি বুঝতে পারলা এতোক্ষনে, মানুষ তো কখনই ‘সম্পূর্ণ আছিলো না’ জগত জুড়ে । তবু, ‘কি জানি একটা জিনিস হারায় গেছে তার’— এইরকম একটা ফিলিংস সবসময় তাড়া করতে থাকে তারে।

তাই, মানুষ সেই একটা জিনিসরে খোঁজে— ‘হারায় গেছে’ ফীলিংসটারে স্যাটিসফাই করবার ভান ধরে।

পরের দিন৷ ঘোলাটে আকাশের দিনে৷ অশান্ত মৌশুমের দিনে। তুমি আবারও সেই মাইয়াটার কাছে ফিরে গেলা৷

তুমি প্রতিশ্রুতি দিলা— তুমি দিবা তারে যা কখনই ছিল না তোমার কাছে– তোমার শূন্যতা–  তোমার শূন্যস্থান।

আর এইদিকে, একটা দমকা হাওয়া চারিপাশ দখল করিতে থাকে। দমকা হাওয়ায় ভাইঙ্গা পড়তে থাকে পুরা দুনিয়া। আদম সন্তানরা স্তম্ভিত হইয়া ভাবে, কি হইলো আজ দুনিয়ার? দুনিয়া কি পাগল হয়া গেলো?

হাওয়ার উপস্থিতিতে দুনিয়ার আদমরা কি পাগল হয়া গেলো?

গল্পকারঃ শোয়েব বিন আজিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।