সাতটি ব্যাঙ্গাত্মক গল্পের সমষ্টিতে ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয় আবুল মনসুর আহমদের প্রথম বই, ‘আয়না’। বন্ধু আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে উৎসর্গ করা সে বইয়ের ভূমিকা লিখে আবুল মনসুর আমহদকে চিরঋণী করেন, তৎকালীন সর্ববিখ্যাত কবি, কাজী নজরুল ইসলাম।
আয়নার প্রতিটি গল্পই পূর্বে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সম্পাদিত সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এবং এ গল্পগুলোর পেছনে আবুল মনসুর আহমদের একটি জেদী প্রস্তুতি ছিল।
১৯২৬ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন দ্বিতীয় দফায় সওগাত প্রকাশের প্রাক্কালে আবুল মনসুর আহমদকে লেখক হিসেবে সাথে নিলেন। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনকে আবুল মনসুর আহমদ বলেছিলেন, “আমি যা লিখব সেটা তো মুসলমান সমাজের এসব ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। আমার যা চিন্তা, মুসলমান সমাজ তা হজম করতে পারবে না”। আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের নিকট প্রকাশ করা আবুল মনসুর আহমদের সেই কুসংস্কার-বিরোধী চিন্তা সুস্পষ্টরূপে বিকশিত হয়েছে ‘আয়না’র সাতটি গল্পে।
বইয়ের নাম-শিরোনাম তথা ‘আয়না’ নামে কোনো গল্প নেই; তাহলে ‘আয়না’ নামকরণ কেন? আমরা সাধারণত আয়নায় নিজেদের প্রতিচিত্র দেখে থাকি, আবুল মনসুর আহমদ এমন একটি ‘আয়না’সৃষ্টি করেছেন যার সামনে দাঁড়ালে আমাদের সমাজের প্রতিচিত্র ভেসে উঠে অত্যন্ত স্পষ্ট আকারে। কাজী নজরুলের ভাষায় যা ‘মানুষের অন্তরের রূপ’ হিসেবে পরিগণিত।
প্রথম গল্প ‘হুজুর কেবলা’; পীর সেজে বাঙালি-মুসলমান সমাজে ব্যাঙ্গের ছাতার মতো বেড়ে উঠা অতিপ্রাচীন ভণ্ডামির কুৎসিত একটি দিক প্রকট হয়ে প্রকাশ পেয়েছে এতে। গল্পে লেখক দেখিয়েছেন, ভণ্ডরা ভণ্ডামী করতে করতে এতোটাই নীচে চলে যায় যে, তাদের লালসা মেটানোর জন্য স্বয়ং নবীকে পর্যন্ত ব্যবহার করতে এতটুকুও কুণ্ঠাবোধ করে না। দ্বিতীয়ত, কথিত সুফি সাহেবের মাধ্যমে ভণ্ডদের একটি চেইন তিনি সৃষ্টি করেছেন, যার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়, ভণ্ডামি কেউ একা করে না; একটি দল, গোষ্ঠী একত্রে ভণ্ডামিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকে। ‘গো-দেওতা কা দেশ’ নামের গল্পে, লেখক তৎকালীন তথা ত্রিশের দশকের চরম রাজনৈতিক গোলযোগের মধ্যেও কিছু হিন্দু নেতার বক্তব্য ও লেখনীতে বাঙালি-মুসলমানের চেয়ে ‘গো’কে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে সূঁচালো পন্থায় শক্ত প্রতিবাদ করেছেন। ‘নায়েবে নবী’ গল্পের মূল চিত্র হচ্ছে, মৌলবী সুধারামী এবং গরিবুল্লাহর মধ্যকার স্বার্থদ্বন্দ্ব; নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য কীভাবে নিরক্ষর গ্রামবাসীকে কোরান-হাদিসের অপজালে তারা বেঁধে রেখেছে তা-ই চিত্রায়িত হয়েছে। ‘লীডরে-কওম’ গল্পে মূলত দেখানো হয়েছে, ইসলামের নাম ভাঙিয়ে সরলমনা মুসলমানদের নিকট থেকে অর্থ সংগ্রহ করে কীভাবে ইসমাইল সাহেব রাতারাতি গো-বেচারা থেকে একটা পত্রিকার সম্পাদক এবং তদুপায়ে স্থানীয় আলেমদের ‘মুরুব্বী’বনে গেলেন। ইসলামের নামে চাঁদা আদায় করে পকেট ভারী করার দৃশ্য এখনো আমাদের সমাজে বেশ সুলভ। এ গল্পটি রচিত হয়েছিল তৎকালীন এমনই এক খ্যাতনামা সম্পাদক এবং নামধারী আলেমের জীবনেতিহাসকে কেন্দ্র করে। ‘মুজাহেদিন’ গল্পে নামধারী আলেমরা কীভাবে স্বার্থ হাসিলের তাগিদে সরলমনা মুসলমানদের মাঝে ফেরকাবাজী, শ্রেণিগত দ্বন্দ্বের পসরা সাজিয়ে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করেন এবং এই ফাঁকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেন তারই উৎকৃষ্টতর দৃশ্যপট অঙ্কিত হয়েছে। গল্পের তরুণ নেতা ‘সাদত’কে সমাজের শান্তিকামী-শ্রেণির একজন প্রতিনিধিরূপে দেখলে এ গল্পের চির-প্রাসঙ্গিকতা হৃদয়ঙ্গম করতে সহজ হয়।‘বিদ্রোহী সংঘ’ গল্পে ফুটে উঠেছে, ইংরেজ তাড়ানোর লক্ষ্যে গত শতকের ত্রিশের দশকে এমন কিছু সংঘ গড়ে উঠেছিল যারা অনেক বড়ো বড়ো কথা বলতো কিন্তু সাহসে এবং কাজে তার ছিটেফোঁ টাও দেখা যেত না। আজও আমাদের সমাজে হরহামেশাই এমন অকর্মক সংঘের দেখা পেতে কষ্ট হয় না। ‘ধর্ম রাজ্য’ নামক সর্বশেষ গল্পে মুসলমান-হিন্দুর মাঝে দাঙ্গার মূল কারণ এবং উভয় সম্প্রদায়ের করুণ পরিণতির দৃশ্য ফুটে উঠেছে নির্মম ভাবে। গল্পের উপসংহারে প্রকট আকারে লেখকের ধর্মোর্ধ্ব মানবিক দৃষ্টি পাঠকের চোখে সহজেই ধরা দেবে।
‘আয়না’র স্রষ্টা হিসেবে লেখক আবুল মনসুর আহমদের মানস বুঝতে সওগাত-সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ স্মৃতি গ্রন্থের দ্বারস্থ হতে হয়। তাতে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন লিখছেন: “আবুল মনসুরের কথা ছিল, আমি অনেক বিষয় নিয়ে চিন্তা করি। আমার মাথায় এসব চিন্তা সবসময় কিলবিল করে। কিন্তু কথা হলো, আমার লেখা কেউ ছাপবে না। আমি বলি, কেন ছাপবে না? তিনি বললেন, মুসলমান সমাজে এমন কোনো কাগজ নেই যারা আমার লেখা ছাপবে। কারণ, আমি প্রথমেই আক্রমণ করব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, ভণ্ডামির বিরুদ্ধে, এই সংসারে যত ভণ্ড আছে, তাদের বিরুদ্ধে। বলুন ভণ্ডরা কি তাদের কাগজে ছাপবে এ রকমের লেখা? এসবই বললেন আবুল মনসুর আহমদ। আমি বললাম, আমি ছাপাব আপনার লেখা। আপনি আমাদের সঙ্গে থাকেন। মনসুর সাহেব কতক্ষণ ভেবে বললেন, আপনি বেশ সাহস করেছেন। ঠিক আছে, আমি লিখব। এরপর তিনি লেখা দিলেন। নাম লীডরে কওম, তারপর হুজুর কেবলা। তার মানে আবুল মনসুর আহমদের ‘আয়না’ বইতে যত ব্যাঙ্গ রচনা আছে, তার সবই আমি তাঁকে দিয়ে লিখিয়েছি।” সাংবাদিক জগতের প্রবাদ-পুরুষ মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের উপর্যুক্ত সাক্ষ্যমতে, আমরা আবুল মনসুর আহমদের কুসংস্কার-বিরোধী এবং ভণ্ড-বিদ্বেষী মনোভাবের আদিমানস দেখছি অন্তরঙ্গ আলোকে। গল্প ছাপানোর পূর্বে কেবল আশ্বাসেই আবুল মনসুর আহমদ যেভাবে সওগাত-সম্পাদকের সাহসিকতার তারিফ করলেন সেভাবে গল্প প্রকাশ হওয়া এবং গল্পগুলোর সংকলনে একটি স্বতন্ত্র গল্পগ্রন্থ বের হবার পঁচাশি বছর পরেও কিন্তু সেভাবে আমরা ‘আয়না’র মুগ্ধপাঠকবৃন্দ নাসিরউদ্দীন সাহেবের তারিফ করি না! লেখক হিসেবে আবুল মনসুর আহমদের পাশাপাশি দুঃসাহসী প্রকাশক হিসেবে সওগাত-সম্পাদক নাসিরউদ্দীনের তারিফ না করলে ‘নেমকহারামি’ হবে বলে মনে হয়। কারণ, ‘নেমক’র দাতা মনসুর সাহেব হলেও একমাত্র উসিলা কিন্তু নাসিরউদ্দীন।
এ গল্পগ্রন্থের সবচেয়ে আকরণীয় গল্প ‘হুজুরে কেবলা’; অন্য আরও ছয়টি গল্পও প্রেক্ষাপট এবং চারিত্রিক দিক থেকে বেশ শক্তিশালী। আবুল মনসুর আহমদ মূলত এ গল্পগ্রন্থের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন, বাঙালি-মুসলমানের স্থবিরতার মূলে অশিক্ষিত মোল্লা-সমাজ কতটা দায়ী এবং তাদের স্বার্থসিদ্ধির বলি হয়ে বাঙালি-মুসলমান যুগ-যুগ ধরে কতটা অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহায় বাস করে আসছে। লেখকের মূল-মানস হচ্ছে, বাঙালি-মুসলমান ধর্মভীরু বা ধর্মান্ধ, ধর্মনিষ্ঠ বা ধর্মানুরাগী নয়; আর তাদেরকে ধর্মভীরু করে রেখেছে কুশিক্ষিত মোল্লা-সমাজ। প্রতিটি গল্পের প্রতিটি চরিত্রের সাথে ভাষার যে সংযোগ তিনি ঘটিয়েছেন তাতে অবাক না হয়ে উপায় থাকে না। আরবি-ফারসিতে মুখরিত তৎকালীন বাঙালি-মুসলমানের ভাষার নমুনা দেখতেও ‘আয়না’র প্রাসঙ্গিকতা বর্তমান। এ চির-প্রাসঙ্গিক গল্পগ্রন্থের গুরুত্ব বোঝাতে একবাক্যে বলা যায়, ‘আয়না’ মূলত ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পূর্বে বাঙালি-মুসলমানের সামাজিক মানচিত্র, যাতে দৃষ্টি ফেললেই বাঙালি-মুসলমানের আদি মানসপট হলফ করে আত্মস্থ করা যায়। ‘আয়না’র লেখক হিসেবে আবুল মনসুর আহমদের সার্থকতা কোথায়? যখন পাঠক কাঠমোল্লাদের বিভ্রান্তি থেকে পরিবারকে, সমাজকে সুরক্ষা করতে সাবধান হবে; যখন পাঠক ব্যাঙ্গস্রোতে ভেসে কেবলই না হেসে গল্পের অচিন্তার্নিহিত তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করে বাস্তবতায় প্রয়োগ করবে তখনই লেখক হিসেবে আবুল মনসুরের সার্থকতা নিশ্চিত হবে।
লেখক আবুল মনসুর আহমদের মুনশিয়ানা স্বীকার করতে যে কোনো পাঠকেরই দু’বার ভাবা নিষ্প্রয়োজন। বর্তমান বাংলাদেশের নৈতিকতাবর্জিত সমাজের অন্ধকারে ঢাকা কুৎসিত চিত্রগুলো যদি কেউ জনসাধারণে তুলে ধরতে চান তবে তার জন্য আবুল মনসুর আহমদ এবং তাঁর ‘আয়না’ হবে অনুপ্রেরণার সর্বোচ্চ আশ্রয়। তবে সবশেষে আমাদের ফিরে যেতে হয় কাজী নজরুল ইসলামের নিকট, যিনি ভূমিকাতে লেখকের মুনশিয়ানা সম্পর্কে অকুণ্ঠচিত্তে লিখেছেন, “আজ বন্ধু আবুল মনসুরের হাত-সাফাই দেখে বিস্মিত হলুম। ভাষার কান মলে রস-সৃষ্টির ক্ষমতা আবুল মনসুরের অসাধারণ। এ যেন পাকা ওস্তাদী হাত!” মানুষের চাহিদা পূরণ করতে লিখলে জনপ্রিয় হওয়া যায় আর মানুষের প্রয়োজন উপলব্ধি করে লিখলে হওয়া যায় অমর: তৎকালীন সমাজে ‘আয়না’র বিন্দুমাত্রও চাহিদা ছিল না, কিন্তু অনেক প্রয়োজন ছিল; তাই আবুল মনসুর আহমদ জনপ্রিয় হলেন না, হলেন অমর।
*গবেষক ও সম্পাদক, মজলিশ