আ নিউ ক্যামেল ওয়াকস ইন্টু দা টাউন

তন্ময় পাল অন্তু

(এই লেখাটা আমার আসলে লেখার কথা বহু আগে, বহু বহু আগে। যখন ক্যামেল নামের এক সিগারেট নীল হলুদ বেঞ্চের রঙে নগরের কোটি কোটি দোকান রাঙায় দিলো, তখন। কি যে লেখার কথা, তাও ঠিক জানি না। শুধু মেসবাহ ভাই একটা টাইটেল ধরায় দিয়া বললো, কিছু একটা লিখতে।)

এরপর লক্ষ লক্ষ মাস পার হইয়া গেলো। এই কয়েক মাসে ক্যামেলের মার্কেটে অনেক আপ্স অ্যান্ড ডাউনস দেখলাম। ক্যামেল আইলো, অনেক গুল্লিপ আর লাকিপন্থী মানুষ এক সেকেন্ডে পল্টি মাইরা হইয়া গেলো টিম ক্যামেল। এর পিছনে দুই তিনটা কারণ আইডেন্টিফাই করা গেলেও, এক নম্বর কারণটা আসলে ট্যাকা। দশটাকা আর বারোটাকা থেকে আটটাকায় নাইমা আসতে পারা অনেক মানুষের জন্য বিশাল একটা গুড নিউজ। আরো কিছু কারণ হয়তো ছিলো, টেস্ট বা ফ্লেভার রিলেটেড। এরপর ক্যামেলের এই জনপ্রিয়তার ট্রেইনে বাগড়া দিতে লাকিও বৃষ্টির মতো নতুন ফ্লেভার আনলো, আর ঢাকা টু কক্সবাজার ট্রেইন লাইনের মতো এই বৃষ্টিতে ক্যামেলেরও জনপ্রিয়তা এখন একটা উঠানামার মধ্যে আছে। তবে এতো এতো সিগারেট ব্র্যান্ডের এতো এতো ডায়নামিকের মাঝে দাঁড়ায় আমার একটা প্রশ্ন, এই দেশে, এতো সিগারেট মানুষ আসলে কেনো খায়? নিকোটিনের নার্ভ রিলাক্সিং পার্ফরমেন্সের কথা আমরা আসলে সবাই কমবেশি জানি। কিন্তু এত এত নার্ভ রিল্যাক্স করার এই সামগ্রিক ঠেলা আমাদের কেনো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে বেশ মজার কয়েকটা বিষয়ের উপর নজর গেলো।

এক, ডিমের এই কম্পিটিশন দিয়া দাম বাইড়া যাওয়া। ডিম যখন ৮-৯ টাকা পিস, তখনও মানুষরে বলতে শুনসি সিগারেট না খাইয়া, ওই টাকা দিয়া একটা ডিম খান। এখন ডিমের দাম যেহেতু ১৫র ঘরে, সমাজের এলিট শ্রেণীরে ছাড়া আর কাওরে ডিম খাওয়ার কথা বলা যাইতেছে না বিড়ির বদলে, যেখানে আবার ক্যামেল ধরাইলে এক ডিমের দামে দুইটা বিড়ি খাওয়া যাবে। এই কষ্টে মনে হয় বিড়ির বদলে ডিম খাইতে বলা মানুষগুলাও বিড়ি খাওয়া শুরু করছে। আসলে করার কি আছে বলেন, পনেরো টাকায় আপনি পাবেন শুধু ডিম, এইটা যেকোনো ভাবে প্রসেস করাইতে গেলেই আপনার আরো এক্সট্রা পয়সা যাবে। কিন্তু এইযে একটা বিড়ি, এইটা খাইতে খালি লাগে আগুন, তাও আবার সেইটা বিড়ির দোকানে ফ্রিতে পাবেন। তাইলে আমারে বলেন, যেই লোক একটাই ক্যামেল অ্যাফোর্ড করতে পারে, সেই লোক ডিম খাবে কেমনে?

দুই নাম্বার যেই জিনিসটার দিকে চোখ গেলো তা আসলে যতটা না বিড়ি রিলেটেড, তার চেয়ে বেশী আমাদের এন্টারটেইনমেন্ট স্ট্রাকচারের সাথে যায়। তা হইলো, অত্যন্ত দুঃখের সাথে সারাংশ করলে বলা যায়, আমাদের আসলেই নার্ভ রিল্যাক্স করার, স্ট্রেস রিলিভ করার, এন্টারটেইন্ড হওয়ার সোশ্যাল জায়গা নাই। বেডা মানুষের জন্য যা আছে, তা ওই সিড়ির নিচে বিড়ির দোকান। শুধু যে ব্যাডা মানুষের সমস্যা এইটা, তা না। বেডিমানুষের জন্য সমস্যাটা আরো এক ধাপ উপরে, ব্যাডামানুষ তো তাও বিড়ির দোকানে দুনিয়ার যত অত্যাচারী, সবাইরে তাড়াইয়া কোন দেশ কেমনে দখলে নিবে তা পরিকল্পনা করতে পারে। বেডি মানুষের ওই অপশনটাও নাই। এরজন্য দেখবেন আমাদের নারীরা কম্প্যারেটিভলি সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক ইনভেস্টেড এখন, ভারতীয় ডেইলি সোপ গোগ্রাসে গিলার কালচারটা মনে হয় আগের চেয়ে আধা বা এক ইঞ্চি কমছে। শুধু নারী না, ব্যাডারাও সমানতালে ইনভেস্টেড। যার কিছু নাই, তার আছে এন্ডলেস সোয়াইপিং। এলাকার যত মাঠ ঘাট, সব করো দখল, তুলো বিল্ডিং। সাজসজ্জার বদৌলতে মাঠ আবার থাকবে কয়েকটা। উঁচু উঁচু ট্রান্সপারেন্ট বর্ডার সহ। যারা এই গেইটেড কম্যুনিটির মেম্বার, ওদের তো সকালে জগিং করা লাগবে, নাকি?

সোশাল এন্টারটেইমেন্টের জন্য আছে তাও, কিছু জায়গা। এমন জায়গার বেশীরভাগেই আবার ঢুকার খরচ আর এন্টারটেইন্ড হওয়ার খরচ দেশের মেজরিটি মানুষের এক সপ্তাহ খাবারের খরচের সমান বা বেশী। যেমন টগী ওয়ার্ল্ড, বা সিনেপ্লেক্স। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমরা কেনো সিনেমাহল না বইলা সিনেপ্লেক্স বলতেছি। তার কারণ বলতেছি, আগে ভাবেন, দুই হাজার তেইশ সালে আইসাও বছরে কয়টা সিনেমা বাইর হয়, অ্যাফর্ডেবল সিনেমা হলে, যেই সিনেমার কাহিনী দুর্দান্ত রকম বস্তাপচাও না, আবার কোন তামিল সিনেমার কপিও না। এখন আপনি হয়তো আবার সেই তেরশো তেষট্টি খ্রিস্টপূর্বের আলাপ পারবেন, ‘না আসলে দেখেন আমাদের দেশের টেকনোলজি তো আসলে এখনও এতো উন্নত না’।  টেকনোলজির আলাপ তো অনেক অনেক পরে আসে। ওয়েস অ্যান্ডারসনের অ্যাস্টেরয়েড সিটি দেখলাম রিসেন্টলি। এই সিনেমা তো একটা ক্যামেরা নিয়া একটা মাঠ ভাড়া নিয়াই বানায় ফেলা সম্ভব, যদি আপনি ওয়েস অ্যান্ডারসন হন। আমি আপনাদেরকে ওয়েস অ্যান্ডারসন হইতেও বলতেছি না প্লিস ভুল বুইঝেন না। কিন্তু সরকারের এতো বড় সাফল্য মানুষের হাতে হাতে স্মার্টফোন দিছে, তা এই গ্লোবালাইজেশনের যুগে আপনি যদি আমার স্মার্টফোনে যা দেখা যায় তার চেয়ে বেটার না পারেন, বা অ্যাটলিস্ট সমান না পারেন, তাইলে ভাই, বাদ দেন। বিদেশী চলচ্চিত্র আসলে আপনার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি হুমকির মুখে পরবে বইলা যেই কান্দনটা দিছেন, সেই কান্দনটা সিনেপ্লেক্সে নতুন সিনেমা আসার সময় তো কানতে দেখি না। আজকে সিঙ্গেল স্ক্রিনে রিলিজ হবে দেইখা আপনাদের মনে দারুণ ভয়। যারা সিনেপ্লেক্স অ্যাফোর্ড করতে পারে না, তারাও এখন জাইনা যাবে কি ছাইপাশ আপনারা বানান আর আমরা গিলি, এরপর আর ব্যবসা কেমনে করবেন?

আর আছে আমাদের ব্যাঙের ছাতার মতো গইড়া ওঠা রেস্টুরেন্ট। বন্ধুর সাথে দেখা? যাও বাইরে খাইতে। ডেইট? যাও বাইরে খাইতে। হ্যান ত্যান যেকোনো সোশাল আউটিং? যাও বাইরে খাইতে। বাইরে খাইতে আবার দুইটা অপশন শুধু। আইদার আপনি বর্ডারলাইন স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ খাবার খাবেন, অথবা এই এক বেলা খাওনের পিছনে আপনার খরচ হবে কাড়ি কাড়ি টাকা। এই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার যোগান কি? স্টুডেন্ট থাকাকালীন ৯৫% ছাত্রছাত্রীর জন্য নাই কোনো প্রপার পার্টটাইম জব। আপনি একটা ডিগ্রি নিয়া বাইর হবেন, আপনার স্টার্টিং স্যালারি নাকি ১৫ হাজার টাকা, সপ্তাহে ছয়দিন চাকরি বাসা ভাড়া দিতে হইলে, খাওয়াটা নিজের বাসাতেই করতে পারবেন না অভাবে। বাইরে খাওয়ার কথা বাদই দিলাম। এই স্টার্টিং চাকরিগুলাও এখন ওই মানুষগুলার জন্য বরাদ্দ হইয়া গেছে, যাদের এই ফালতু শহরটায় নিজেদের হাউজিং আছে। এর বাইরে কেউ থিওরেটিকালি চাকরি পাইতে পারে ঠিকই, কিন্তু পাইলে তার পেটে আর ভাত পড়বেনা, রেগুলার অফিস করার জন্য।

এইগুলা খুবই সার্ফেস লেভেলে করা ঠুনকো কিছু আলাপ। আরো সময় সুযোগ নিয়া, বিড়ির দোকানে বইসাই আলাপটা বড় করা যাইতে পারে। একটা স্বাস্থ্য সচেতন সমাজের সবচেয়ে বড় শত্রু মনে হয় বিড়ির দোকান, তবে আমরা তার হুবহু মিরর অপোজিট। বিড়ির দোকানই আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু, সবচেয়ে বড় পরিবার। এই লেখাটা আমার জন্য একই সাথে একটা রেইস অ্যাগেনস্ট টাইম। ২০১৬ সালে এক বিড়ির দোকানকে সেন্টার কইরা আমাদের ‘সক ফোর বয়েজে’র যেই শুরু হইছিলো, তা এতোদিনে মইরা গেছে মানুষ কমতে কমতে, আজকে তার কবর দিতে যাবো। বন্ধু হগস অ্যালবার্টায় উড়ে যাবে আর কিছুক্ষণ পরে। সক ফোরের সোনালি সময়ের সবচেয়ে অ্যাক্টিভ মেম্বারদের একজন। এই লোকটার সাথেও আমার আর কিছু করার নাই, কোন একটা বিড়ির দোকানে চায়ের কাপ হাতে নিয়া হাসতে হাসতে ভাঙ্গা মন নিয়া লোকটাকে বিদায় দিতে হবে। এই বাজারটা বাকি সব বাজারের মতো আনস্টেবল না। কোন বাজেটের আগে পরে কি হবে, মোটামুটি অনুমান করা যায়। আর কোন ব্র্যান্ড আয়ত্বের বাইরে চইলা গেলেও আসলে খুব একটা ভয় নাই, আ নিউ ক্যামেল উইল অলওয়েজ ওয়াক ইন্টু দা টাউন।

কেউ আসে, কেউ যায়
সক ফোরের রাস্তায়
আর সংখ্যা কমতে থাকে
আমাদের আড্ডায়

কেউ বিদেশ দেয় পাড়ি
কারো আকাশে নতুন ঘর

দিনশেষে সক ফোর আমাদের সবার
সক ফোরে কেউ নয় পর।

লেখকঃ তন্ময় পাল অন্তু, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়