একজন আর্টিস্ট তাঁর শৈশবে ভর দিয়ে বেঁচে থাকে, পরজীবির মতো: ফিল্ম কারিগর আন্দ্রেই তারকোভস্কির সাথে আলাপ। 

ক্লেয়ার ডেভেরৌ, ১৯৭৮ 

তরজমা: ভুঁইয়া মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান

“নারী প্রসঙ্গে আমার সামান্যই বলার আছে— তারকোভস্কি বলতেছেন— আমার ফিল্মের সাবজেক্ট হচ্ছে একটা লোক যার কাজ গল্পের নারীদের সাথে শিশুদের যোগসূত্র বুনন, তাদের এক জায়গায় আনা। 

তবে, সে নিজে পুত্র বা স্বামী হিসেবে খুব যে লায়েক তা না, এবং বাচ্চাগুলারও একজন অভিভাবক দরকার, দরকার একটা বাবার। সে আসলে একজন গল্প কথক, যে জন্য সে পুরো ফিল্মেই থাকে স্ক্রিনের বাইরে। আমরা তাকে একবার দেখতে পাই যখন তার বয়স ছয়, এবং শেষ বারের মত, যখন সে বারো, যুদ্ধের সময়।” 

“রিশতা… আত্মীয়তার সেতুগুলা ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ে আছে, আর গল্প কথকের সেগুলা মেরামত করতে হবে, তার নৈতিক ভারসাম্য খুঁজে পেতেই তাকে এইটা করতে হবে, কিন্তু সে পেরে উঠতেছে না। তার উপর ভালোবাসার যতো ঋণ, সব কর্জ-ধার-দেনা একদিন শোধ করে দিতে পারবে, এই আশা নিয়া সে বেঁচে যাচ্ছে, কিন্তু এইটা এমন এক ঋণ যা থেকে রেহাই নাই কারোর।” 

“নারীরা জানে কেবল সব বরবাদ করতে! আরেহ না না, মজাই করতেছিলাম। আমরা তাদের ভূমিকা এভাবেই অনেকটা বুঝতে পারি, কিন্তু আমরা তাদের ভালোবাসি, যেমন আছি তেমন টা তারাই আমাদের গড়ে দিয়েছেন। তারা অবিচল, গোঁয়ারও— আমাদের মধ্যে একটা শিশু তারা অলোয়েজ বাঁচিয়ে রাখতে চায়, অথচ ততদিনে প্রায় বুড়িয়ে গেছি আমরা। ‘আয়না’ (Mirror, 1975)— এইটা এমনেই দিয়ে দেয়া কোন নাম না। গল্প কথক এইখানে নিজের বউকে তার মায়েরই অকর্তিত একটা ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখতেছে, কারন বউয়েরা অনুরুপ হয় মায়েদের, আর ভুলগুলার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে— অদ্ভুত এক প্রতিফলন। পুনরাবৃত্তি হচ্ছে একটা বিধি, অভিজ্ঞতা স্থানান্তর করা যায় না, সবাইকে নিজেরটা বাঁইচা দেখতে হয়।” 

“আমার ফিল্মে প্রকৃতি সবসময় থাকে, এবং এইটা কোন স্টাইলের প্রশ্ন না, বরং এটাই সত্য। যখন বাবা যুদ্ধ করতে যায়, তখন প্রত্যেক বসন্তে আম্মা আমাদের নিয়া গ্রামে চলে যেতো। সেই থেকে আমি আম্মা আর প্রকৃতিকে এক করেই দেখি।” 

“একটা শহুরে লোক জীবন সম্বন্ধে কিছুই জানে না, সময় বয়ে কীভাবে যাচ্ছে সে অনুভব করে না, জানে না সময়ের স্বাভাবিক প্রবাহ৷ একটা শিশু প্রকৃতির সাহচর্যে নিজের উপর ভরসা পায়, অদেখা ভবিষ্যতের মুখোমুখি আশ্বস্ত বোধ করে, প্রকৃতির অভয়ারণ্যে নিজের ইচ্ছাশক্তির ঋদ্ধ-রূপ দেয় কুমোরের দক্ষতায়। আর এই মগ্নতা— প্রকৃতিতে একান্ত থাকার এই অভ্যাস— এই মগ্ন-চৈতন্য পরবর্তী জীবনে হরেক মানুষের সাথে উঠাবসায় তাকে সক্ষম সংবেদী করে তোলে। কেউ যদি কেবলই সামাজিক জীব হয়, তাহলে তাকে অন্যের ইচ্ছের কাছে নিজেকে সোপর্দ করে শুধু বাঁচার কায়দা-কসরত করে যেতে হবে। অবচেতনভাবেই, আম্মা জানতেন যে প্রকৃতিসঙ্গ অপরিহার্য, তাই তিনি আমাদের মধ্যে একটা চাষী সংস্কৃতির আবাদ করেন।” 

“দু’বছর আগে আমি আর আমার বউ গ্রামে গিয়ে ছোট্ট একটা বাড়ি নিলাম। সেখানে যাওয়ার জন্য আমার ছেলের অধৈর্য্য–যেন তর সইছে না– দেখে আমার আনন্দই লাগতেছে। সেখানে এখন অবধি সেই একমাত্র শিশু। আমার ছেলের ব্যক্তিসত্তার রাশিয়ান সাইড টা পরিবারের সেই ধারনার সাথে জড়িত যেটা প্রকৃতি লাগোয়া।” 

“এই ফিল্ম টা করার পরে আমার আর কিছু মনে নাই। স্মৃতি হলো এই মুহুর্তের সওগাত, ঠিক যখন আমি কথা বলছি সেই ক্ষণিকেরই— অতীতে ফিরে তাকানো নয়। এই যে অতীত, যেটা আমি কাঁধের মধ্যে নিয়ে ঘুরতেছি, মাঝেমধ্যে দরকারি হলেও খুব ভারি একটা বোঝা মনে হতে থাকে।” 

“সকল শৈল্পিক প্রচেষ্টা নির্ভর করে স্মৃতির উপর, আর শিল্প বা কলা হচ্ছে স্মৃতিকেই ঘষেমেজে পষ্ট স্বচ্ছ করার কৌশল। গাছে থাকা পতঙ্গের মতন— একজন আর্টিস্ট তাঁর শৈশবে ভর দিয়েই বেঁচে থাকে— পরজীবির মতো। বাদবাকি জীবন সে তাই খরচা করে যা সে শৈশবে কামাই করেছে, সে ধী…রে বয়স্ক হয়ে ওঠে, আর ম্যাচিউরিটি– বয়সের অনমনীয়তাই সবকিছুর শেষ, ক্ষান্তি।” 

তরজমাঃ ভুঁইয়া মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।