বৃষ্টির এমন দিনে, খেলতে না পারার দুঃখ নিয়ে আশরাফ, কোনো এক দুপুরে সন্ধ্যার মত অন্ধকারে বসে ছিল ঘরে। তখন আশরাফের বয়স সাত, সাদিয়ার বয়সও এমন কাছাকাছি কিছু, আরো অনেকের বয়স এমন ছিলো হয়ত আলফালা গলির তিন তলা বাড়িটায়, সেই সব বয়সের কেউ, বৃষ্টির দিনটাতে অত মুখ্য হয়ে উঠতে পারে নাই। বৃষ্টির শব্দ পাশের বস্তির টিনে ঝমঝম করতেছিল যখন, তখন সাদিয়ার আম্মা আব্বার গলা তারও অধিক চিৎকার করতেছিল, ঝগড়ার এমন ফাকে তালে সাদিয়া এসে বসছিল আশরাফের বাসায়, অন্য ঝগড়ার দিনগুলার মতই। আশরাফের আম্মা সাদিয়ারে এইসব ঝগড়া থেকে দূরে এনে রাখতো প্রায়, অন্য গল্প বা কিছুতে করে রাখতে চাইতো ব্যস্ত, কিন্তু এসব ঝগড়া এমন ঐ বয়সে বুঝা না গেলেও সঠিক, বিষাদ ঠিকই থেকে যেতো তার মুখে। সেদিনও এমন বিষাদ নিয়ে ঘরে ঢুকছিল সে, আশরাফও ঘরে বসে ছিল বৃষ্টিতে বেরুতে না পারার দুঃখ নিয়ে।
আলফালা গলির ঐ তিন তলা বাড়িটায় ওরা যারা থাকতো কাছাকাছি বয়সের দশটা বাসায়, সবাই প্রায় এক সাথে খেলতো নিচে একটা ছোট উঠানে হাড়িপাতিল মেয়েদের নেতৃত্বে, এই সব খেলার ভেতরেই সাদিয়া আশরাফের ভাল বন্ধু হয়ে ওঠে। বন্ধু হইলেও ছেলেমেয়ে রেষারেষির এক অদ্ভুত নিয়ম থাকাই প্রায় ঝগড়া হয়ে থাকতো ওদের।
ঐ বৃষ্টির দিনটায় এমন ঝগড়া ছিল ওদের, আশরাফ তাই হয়ত মুখ ভ্যাংচাইয়া বলছিল ওরে “একটা মেয়ে বেহায়া, মাতিনা তাও আমাদের বাসায় আসছে”। অন্যদিন হইলে হয়ত সাদিয়া কিছু বলতো, অথবা চলে যাইতো, কিন্তু সেই দিন সে সন্ধ্যার মত অন্ধকারে সাদিয়া কান্না করতেছিল হঠাৎ, আশরাফের আম্মা ওরে নিয়ে গেছিল ভেতরের রুমে। সেদিন সাদিয়া অনেক্ষন কান্না করতেছিল,ওর বাবামার ঝগড়ার শব্দও বাড়তেছিল অনেক্ষন বৃষ্টির ঝমঝমের সাথে। এভাবে বিকাল হয়ে সন্ধ্যার দিকে যাবে মনে হচ্ছিল সব বৃষ্টি আর ঝড় হাওয়া, কিন্তু সন্ধ্যার আগে বৃষ্টি থেমে যায়, সাদিয়া কাঁদতে কাঁদতে ঘুমায়া পড়ে, ওর আব্বা আম্মা তখনো টুকটাক ঝগড়া করে যায়। সন্ধ্যার দিকে যখন মেঘে মেঘে অন্ধকার অনেক, তখন বৃষ্টির নিয়মিত লোডশেডিংএ মোমবাতির আলো জ্বলায় আশরাফের আম্মা।
আশরাফ দেখে তার আম্মা চা আর বিস্কিট খেতে দিতেছে তাকে আর সাদিয়াকে। সাদিয়ার মুখ ফোলা, চোখ ভেজা তখনো, মোমবাতির আলোয় সে দৃশ্য কোনো রেখাপাত করে কিনা আজ মনে নাই, শুধু মনে আছে চা দিয়ে বেলা বিস্কিট খাবার কথা। আর মনে আছে সাদিয়া আর বাসায় যায় নাই ঐ রাতে, ওর আব্বা আম্মারও কোনো শব্দ শোনে নাই কেউ। পরদিন ভোরে বিষাদের মুখ নিয়ে এসে দরজার কড়া নাড়ে সাদিয়ার আম্মা, আশরাফের আম্মাকে জড়াইয়া কাঁদে অনেক্ষন, আশরাফ ঘুম চোখে জানতে পারে সাদিয়ারা চলে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে সেদিন বুঝা না গেলেও আজ জানা আছে সাদিয়ার বাবামার বিচ্ছেদ হইছিল সেদিন। মেঘমুক্ত সেই ভোরে সাদিয়ারা চলে যায় বাসা ছেড়ে, বাসা ছেড়ে যাওয়া মানে বন্ধুদের চিরতরে ছেড়ে যাওয়া ছিল সেসব সময়। আশরাফ আর সাদিয়াও সেদিন কান্না করে অনেক, কেন কাঁদছিল জানা নাই আজ। এখন তবু বৃষ্টির এমন সব দুপুরে সন্ধ্যার মত অন্ধকারে মনে পড়ে এসব কান্নার কথা, মনে হয় একটা বিচ্ছেদ কতজনরে এই বিচ্ছেদের অংশ করে আলাদা করে দেয় চাইলেও যেখানে থাকা যায় না আর।