মীর মশাররফ হোসেনের শেষ জীবনঃ মুনীর চৌধুরীর বিচার

মোহাম্মদ আবু সাঈদ

মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্য বিচার যাদের হাত ধরে শুরু হয়েছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম মুনীর চৌধুরী। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর মীর–মানস। এই কিতাবে মীর মশাররফের শেষ জীবন ও সাহিত্য নিয়ে বেশ কিছু মন্তব্য করা হয়েছে যা পুনর্বিচারের জোর দাবি রাখে। সেইসব মন্তব্যের পুনর্বিচারই বর্তমান রচনার একমাত্র লক্ষ্য।

প্রথমেই দেখা যাক কিভাবে চৌধুরী সাহেব মীরের সাহিত্য জীবনকে ভাগ করেছেন: “মীর–মানসের ক্রমবিকাশের প্রথম অধ্যায় দীনবন্ধু–মাইকেল–বঙ্কিমের সাহিত্যাদর্শের প্রভাবে পরিপূর্ণ। দ্বিতীয় অধ্যায় ইসলামী চেতনার গৌরববোধে সমুজ্জ্বল। শেখ আব্দুর রহিমের ‘হাফেজ’ (১৮৮৭) পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লেখা দিয়েছেন। স্বসম্প্রদায়ের প্রতি প্রীতি প্রকাশে অকুণ্ঠ হয়েও এঁরা আজকালকার উপদ্রবী অর্থে সাম্প্রদায়িক ছিলেন। তাছাড়া এই পর্বে এখনও মীর সাহেবের প্রধান উৎসাহ সাহিত্যসৃজনে, সাধ্যমত মুসলমানী উপাদানের শিল্পগত রূপায়ণে। তৃতীয় পর্বে, মীরের বৃহত্তম সংখ্যক রচনা শিল্পানুপ্রেরণাহীন। ধর্ম বিষয়ক বাহ্য ও গৌণ ধারণা দিতে আকীর্ণ মীর–মানস এই পর্বে কেবল উপ–পুঁথি–সাহিত্য সৃষ্টি করেই তুষ্ট ছিল।” খেয়াল করলে বোঝা যায়, চৌধুরীর এই ‘ভাগ’ ভাষা–নির্ভর। মীরের প্রথম পর্বকে তিনি যে ‘দীনবন্ধু–মাইকেল–বঙ্কিমের সাহিত্যাদর্শের প্রভাবে পরিপূর্ণ’ দেখলেন, সেখানে তাদের ভাষাকেই মীর হুবহু অনুসরণ করেছেন। খোদা না বলে ঈশ্বর, বেহেশত না বলে স্বর্গ, ফেরেশতা না বলে স্বর্গদূত, তথাকথিত মুসলমানি বাংলা সম্পূর্ণ বর্জন করে সম্পূর্ণ সংস্কৃতে ডুবে গিয়েছিলেন মীর। যে কারণে মীরের এই পর্ব চৌধুরীর কাছে খুব প্রশংসনীয়। তৃতীয় পর্বের ‘ধর্ম বিষয়ক বাহ্য ও গৌণ ধারণা’ দিতে গিয়ে যে মীর ‘উপ–পুঁথি–সাহিত্য’র চেয়ে বেশি কিছু সৃষ্টি করতে পারলেন না তার কারণও ভাষা। কারণ পুঁথি’র একমাত্র স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভাষারীতি। ভাষারীতি ছাড়া আর কিছুই নাই পুঁথিকে আলাদা করে চিহ্নিত করার। অর্থাৎ মীর যখন ফোর্ট উইলিয়াম থেকে কেবলা ঘুরিয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসলো, দেদারসে লিখতে লাগলো ‘আল্লাহ, খোদা, হজরত, বেহেশত, বেশুমার’, তখনই চৌধুরী সাহেব সেগুলোকে ফতোয়া দিলেন ‘উপ–পুঁথি–সাহিত্য’ বলে। দ্বিতীয় প্রসঙ্গ হলো, এই পর্বে মীর রচনা করেছেন বিবি খোদেজার বিবাহ, হজরত ওমরের ধর্ম্ম–জীবন লাভ, উপদেশ, হজরত বেলালের জীবনী, মৌলুদ শরীফ, এসলামের জয়, মদিনার গৌরব, হজরত আমীর হামজার ধর্ম্ম–জীবন, মোসলেম–বীরত্ব ইত্যাদি। এগুলোকে কোন্ দিক থেকে চৌধুরীর ‘বাহ্য ও গৌণ ধারণা’র ব্যাপার বলে মনে হলো? বিষয়গুলো সরাসরি ধর্মসম্পৃক্ত বলে? নাকি অন্য কোনো কারণে? চৌধুরী সাহেব–ই ভালো বলতে পারবেন।

পরবর্তী পৃষ্ঠায় লিখছেন: “১৯০৩ থেকে ১৯১০। রচনার সংখ্যাধিক্যে উর্বরতম এই অন্তিম পর্বে মীর–মানস, শিল্পবিচারে, অবসন্ন ও উদাসীন। মানব–জীবনের রহস্য আর তাঁকে শিল্পানুপ্রেরণা যোগায় নি, ধর্মজীবনের গভীরতর উপলব্ধি তাঁকে উৎকণ্ঠিত করে নি। বেশীরভাগ রচনাই অলৌকিকতামণ্ডিত, কিংবদন্তীপূর্ণ, অসংস্কৃত পুঁথি সাহিত্যের ইসলামের পুনর্নির্মাণ।” দেখা যাচ্ছে ‘অলৌকিকতামণ্ডিত, কিংবদন্তীপূর্ণ’ বিষয়বস্তু চৌধুরী সাহেবের কাছে ‘ধর্মজীবনের গভীরতর উপলব্ধি’র বিপরীত। কিন্তু কেন? ‘ধর্মজীবনের গভীরতর উপলব্ধি’ প্রকাশের জন্য কি ‘ইসলাম ও কমিউনিজম’ লিখতে হবে? কিংবা আরেকটা ‘গো–জীবন’? আর ‘পুঁথি সাহিত্যের ইসলাম’ বিষয়টাই বা কী? পুঁথি সাহিত্যে কি ইসলামের আরেকটা রূপ আছে যা ইসলামের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক? পুঁথি সাহিত্যে চর্চিত বিষয়াবলি নিয়ে আলাপ করলেই কি সেটা ‘পুঁথি সাহিত্যের ইসলামের পুনর্নির্মাণ’? 

মীরের মানস পরিবর্তনের পেছনে একটা সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতাও হাজির করেছেন চৌধুরীঃ “মীর–মানসের এই পরিবর্তনের অব্যবহিত কারণ তাঁর ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে নির্ণয় করা সম্ভব হলেও তৎকালীন বাংলা সাহিত্যে পরিবর্তনশীল ধারাও হয়ত এর জন্যে পরোক্ষভাবে দায়ী। পাশ্চাত্য শিক্ষা নগরবাসী উচ্চ মধ্যবিত্ত হিন্দুকে কার্যত জাতিবৈরী ভাব থেকে মুক্তিদান করে নি। সাহেবের লেখা ইতিহাসে মুসলমান শাসক মাত্রই কামুক ও পীড়ক রূপে অঙ্কিত। স্কুল–কলেজের পাঠ্য বইতে পাদ্রীর ইচ্ছানুযায়ী ইসলাম ও রসুলুল্লাহ্ সম্পর্কে গর্হিত কথা অনেকদিন থেকে চালু ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এই শিক্ষা ও সাহিত্যের বিষাক্ত পরিণাম ফলতে শুরু করেছে। সেকালের মুক্ত–বুদ্ধির অগ্রনায়ক ব্রাহ্মধর্মের নেতারা পর্যন্ত ক্রমে অলক্ষ্যে হিন্দুয়ানীর প্রচারকে পরিণত হলেন। ‘জাতীয় সভা’র কাজ হলে দাঁড়াল ‘হিন্দু মেলা’র তদারক করা। বৃহত্তম মুসলিম পাঠকের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া যে মীরকেও স্পর্শ করেছিল এমন অনুমান করা অসঙ্গত নয়।” তো ‘বৃহত্তম মুসলিম পাঠকের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া’র স্পর্শে মীরের কী পরিণত হলো? চৌধুরী সাহেবের জবানেঃ “সমাজের কল্যাণ–সাধনে নিরুৎসাহ, সাম্প্রদায়িক মৈত্রী–প্রচারে বিমুখতা, মানুষের মহত্ত্বে অনাস্থা, ইহলোকের সৌন্দর্যে অশ্রদ্ধা, সবই ১৮৯৯ থেকে ১৯০৯–এর মধ্যে মীর–মানসে তিল তিল করে দানা বেঁধেছে। মীরের শিল্পানুভূতিও ক্রমশঃ পলায়মান। শেষ আট–দশ বছরে সংখ্যায় অনেক বই লিখেছেন বটে, কিন্তু পূর্বতন মীরের সত্যদৃষ্টি ও শিল্পদৃষ্টি দুই–ই এখানে অনুপস্থিত। বইয়ের নাম প্রমাণ করে যে এগুলোর বিষয়বস্তু সরাসরি ইসলামী ও ধর্মবিষয়ক।” আমরা প্রথম মন্তব্যে ‘বাহ্য ও গৌণ ধারণা’র যে প্রশ্ন চৌধুরীকে করেছিলাম তার জবাব তিনি এখানে দিয়েছেন, কারণ ‘এগুলোর বিষয়বস্তু সরাসরি ইসলামী ও ধর্মবিষয়ক’। যা পূর্বেই আঁচ করেছি। ‘সরাসরি ইসলামী ও ধর্মবিষয়ক’ লেখায় ডুবে যাওয়ার ফলে মীরের মানস বদলে গিয়েছিলো ‘সমাজের কল্যাণ–সাধনে নিরুৎসাহ, মানুষের মহত্ত্বে অনাস্থা, ইহলোকের সৌন্দর্যে অশ্রদ্ধা’য়। প্রশ্ন হলো, ‘সরাসরি ইসলামী ও ধর্মবিষয়ক’ লেখালেখির মাধ্যমে কি সমাজের কল্যাণ সাধন কিংবা মানুষের মহত্ত্বে আস্থা রাখা যায় না? ‘সরাসরি ইসলামী ও ধর্মবিষয়ক’ লেখালেখি করলেই কি ইহলোকের সৌন্দর্যে অশ্রদ্ধা চলে আসে? চৌধুরী সাহেবের কোন্ সেই সমাজ যে সমাজের কল্যাণ ‘সরাসরি ইসলামী ও ধর্মবিষয়ক’ লেখার মাধ্যমে করা যায় না? সে সমাজে নিশ্চয়ই মুসলমান নাই। কারণ যে সমাজে মুসলমান আছে সে সমাজের কল্যাণ সাধন ‘সরাসরি ইসলামী ও ধর্মবিষয়ক’ লেখলেখির মাধ্যমে আরও বেশি হওয়ার কথা। সে সমাজের মানুষের মহত্ত্ব ‘সরাসরি ইসলামী ও ধর্মবিষয়ক’ লেখার মাধ্যমে আরও পরিস্ফুট হওয়ার কথা। কিন্তু চৌধুরী সাহেবের কল্পিত সমাজে যেহেতু মুসলমান অনুপস্থিত সেহেতু মীরের ‘সরাসরি ইসলামী ও ধর্মবিষয়ক’ লেখালেখির মাধ্যমে সে সমাজের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। খুবই মর্মান্তিক ব্যাপার! 

তিনি আরও লিখেছেন: “শেষ আট–দশ বছরে সংখ্যায় অনেক বই লিখেছেন বটে, কিন্তু পূর্বতন মীরের সত্যদৃষ্টি ও শিল্পদৃষ্টি দুই–ই এখানে অনুপস্থিত”। চৌধুরী সাহেবের ‘সত্যদৃষ্টি’ কি শুধু ‘অসাম্প্রদায়িক, সরাসরি ইসলামী ও ধর্মবিষয়ক নয়’ এমন লেখালেখিতেই সীমাবদ্ধ থাকে? মীর যখন তুলনামূলক সেক্যুলার থেকে ‘সরাসরি ইসলামী ও ধর্মবিষয়ক’ লেখালেখিতে শিফট করলো তখনই ‘সত্যদৃষ্টি’ পালিয়ে গেলো? তাহলে কি আমরা ধরে নিবো চৌধুরী সাহেবের ‘সত্যদৃষ্টি’ কেবল সেক্যুলার বিষয়ের জন্যই প্রযোজ্য? 

পরবর্তীতে তিনি বলছেন: “বিষাদ–সিন্ধুর সৃষ্টিকর্তা মশাররফ হোসেন কি এই শ্রেণীর কাব্যের দৃষ্টিভঙ্গী ও আবেদনের স্বরূপ সম্পর্কে সত্যি সচেতন ছিলেন? হয়তো নয়। বৃদ্ধ বয়সে প্রতিভার সাধারণ ক্ষয়, পরিবেশের হীনতায় শিল্পচেতনার বিকার, অবস্থাবিশেষে সহজ রোজগারের প্রতি মানুষ মাত্রেরই দুর্বলতা, সব স্বীকার করে নেবার পরও মীর–মানসের এই বিবর্তনের একটা শৈল্পিক আদর্শগত কারণ লোচন করা সম্ভব। জীবনের উপান্তে এসে মশাররফ হোসেন বৃহত্তর মুসলিম পাঠকের নৈকট্য কামনা করেছেন, পনের আনা নিরক্ষর বা স্বল্পাক্ষর মুসলিম জনতার সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছেন। উদ্দেশ্যঃ তাদের জ্ঞান ও রুচির উন্নতি বিধান।” চৌধুরী সাহেবের এ বক্তব্যের মধ্যে পরস্পর বিরোধিতা দৃশ্যমান। প্রথমে বলেছেন, ‘এই শ্রেণীর কাব্যের দৃষ্টিভঙ্গী ও আবেদনের স্বরূপ সম্পর্কে সত্যি সচেতন ছিলেন? হয়তো নয়’ ; তারপর বলেছেন, ‘জীবনের উপান্তে এসে মশাররফ হোসেন বৃহত্তর মুসলিম পাঠকের নৈকট্য কামনা করেছেন, পনের আনা নিরক্ষর বা স্বল্পাক্ষর মুসলিম জনতার সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছেন। উদ্দেশ্যঃ তাদের জ্ঞান ও রুচির উন্নতি বিধান।’ প্রশ্ন হলো, ‘দৃষ্টিভঙ্গী ও আবেদনের স্বরূপ সম্পর্কে সত্যি সচেতন’ না থেকে কিভাবে ‘বৃহত্তর মুসলিম পাঠকের নৈকট্য কামনা’ এবং ‘মুসলিম জনতার সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ স্থাপনে উদ্যোগী’ হতে পারেন? সচেতন না থেকে কিভাবে সম্ভব বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর ‘জ্ঞান ও রুচির উন্নতি বিধান’–কল্পে কাজ করা? উপরে আমরা দেখেছি, তিনি মীরের শেষ জীবনের ব্যাপারে বলেছেন ‘সমাজের কল্যাণ–সাধনে নিরুৎসাহ’র কথা; তাহলে প্রশ্ন আসে, ‘সমাজের কল্যাণ–সাধনে নিরুৎসাহ’ থাকার পরেও মীর কিভাবে বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর ‘জ্ঞান ও রুচির উন্নতি বিধান’র লক্ষ্যে জীবনের শেষ দশ বছর টানা কাজ করে গেলেন? আমরা আগেই বলেছিলাম, ‘পনের আনা নিরক্ষর বা স্বল্পাক্ষর মুসলিম জনতা’ চৌধুরী সাহেবের কল্পিত সমাজচ্যুত হয়েছেন। কবে, তা ঠিক বলা যাচ্ছে না!  

বইয়ের সূচিপত্রে তাকালে দেখা যায় তিনি মীরের বিবি কুলসুম বই পর্যন্ত আলোচনা করেছেন। তাঁর কথিত ‘সরাসরি ইসলামী ও ধর্মবিষয়ক’ রচনাগুলোকে গোনাতেই ধরেননি। কারণ হিসেবে লিখেছেনঃ “মৌলুদ শরীফ থেকে আরম্ভ করে ‘খোত্বা’ পর্যন্ত মীরের রচনাবলী স্বতন্ত্র মানদণ্ডে বিচার্য।” সেই মানদণ্ডের রূপটা কেমন? চৌধুরী সাহেব নিজে সেই মানদণ্ডে ‘সরাসরি ইসলামী ও ধর্মবিষয়ক’ রচনাগুলো বিচার করতে নারাজ ছিলেন বিধায় আর কিছু বলেননি, তবে যদি তিনি সেই ‘স্বতন্ত্র মানদণ্ডে’র কিছু দিশা আমাদেরকে দিতেন তাহলে আমরা কিছুটা চেষ্টা করতাম বিচার করার। পোড়া কপাল আমাদের! 

ব্যবহৃত গ্রন্থ: মুনীর চৌধুরী রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড : আনিসুজ্জামান সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৪ 

লেখকঃ মোহাম্মদ আবু সাঈদ, লেখক ও সম্পাদক।