(শিল্প) সর্বত্র যাবে

পল ভ্যালেরি

তরজমাঃ মাহফুজ আলম

পল ভ্যালেরি একজন ফরাসি কবি ও দার্শনিক। তাঁর এ প্রবন্ধের কিছু অংশ আপনারা দেখে থাকবেন ওয়াল্টার বেনজামিনের The Work of Art in the Age of Mechanical Reproduction নামধেয় প্রবন্ধের ভূমিকায়। এখানে ভ্যালেরি’র ঐ প্রবন্ধের একটা সম্পুর্ণ অথচ আড়ষ্ট অনুবাদ করা হল। পাঠক, এ প্রবন্ধে আপনি একটা প্রফেটিক আলাপ-সালাপ পাবেন, শিল্প নিয়া।

আমাদের ললিতকলা, এর ধরণ ও ব্যবহার আমাদের কালের চেয়ে ভিন্ন এক কালে গড়ে উঠেছে। আর যারা গড়ে তুলেছেন, আমাদের তুলনায় তাঁদের বস্তুর উপর কার্যক্ষমতা নগণ্য ছিল। কিন্তু, আমাদের কারিগরির চরম উৎকর্ষে, এর অর্জিত অভিযোজন ক্ষমতা আরো নিখুঁত হবার গুণে, এর সৃষ্ট চিন্তা ও অভ্যস্ততার কারণে, এমন এক নিশ্চয় অবস্থা তৈরি হচ্ছে যে, সুন্দরের প্রাচীন চর্চায় বড়সড় রদবদল ঘটতে যাচ্ছে। সকল শিল্পে একটা ভৌত ব্যাপার আছে, সেটাকে আর আগের মত বিবেচনা কিংবা ব্যবহার করা যাবে না, আমাদের আধুনিক জ্ঞান ও ক্ষমতা এড়িয়ে যাবার সাধ্য নেই সেটার। গত বিশ বছরে বস্তু বলি, কিবা স্থান ও কাল কিছুই আর অতীতের মত নেই। আমাদের দেখতে হবে, নতুন সব আবিষ্কার শিল্পকলার সকল কারিগরি বদলে দিচ্ছে, সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে খোদ শৈল্পিক উদ্ভাবন, শেষতক আমাদের শিল্প নিয়ে ধারণাই যাবে বদলে। 

প্রথমে কেবল শিল্পকর্মের পুনরুৎপাদন আর প্রবাহে এ প্রভাব পড়বে। কোন স্থানের কোন বস্তু বা ঘটনা উদ্ভুত সংবেদন প্রণালী কিংবা, নির্দিষ্ট করে বললে, একটা অনুপ্রাণন প্রণালী যেকোন স্থানে পাঠানো যাবে কিংবা পুনরুৎপাদিত করা যাবে। শিল্পকর্ম সর্বত্র গমন করবে। আমাদের মনে চাইলেই সেগুলো ক্ষণিকের মধ্যেই হাজির হবে, হয় তাঁদের সাত্তিক বাস্তবতায় কিংবা অতীত থেকে পুনরুদ্ধৃত রূপে। সেগুলো কেবল স্বকীয় অবস্থানে থাকবে না, বরং বিশেষ কোন যন্ত্র যার কাছে থাকবে তাঁর কাছেও অবস্থান করবে। শিল্পকর্ম কেবল উৎস কিংবা উদ্ভব বিন্দুতে পরিণত হবে, যার সুবিধা হবে সহজলভ্য এবং যেখানে চাইব সেখানে। যেমন পানি, গ্যাস আর বিদ্যুত দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আমাদের ঘরের এনে দেয়া হয়, আমাদের প্রয়োজন পূরণে, খুব কম চেষ্টায়, তেমনি আমাদের ভিজুয়াল বা অডিটরি ইমেজ সরবরাহ করা হবে, যা হাজির হবে কিংবা নাই হয়ে যাবে, হাতের আলতো স্পর্শে, ইশারার চেয়ে বেশি কিছু লাগবে না। আমরা এখন যেমন এনার্জির বিভিন্ন রূপে অভ্যস্ত– একেবারে অধীন না হয়ে পড়লেও, যেগুলো আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ছে, আমাদের এটা একেবারে সহজাত ধরে নিতে হবে ঐসব অতিদ্রুত রূপভেদ ও আলোড়ন যা আমাদের ইন্দ্রিয় জড়ো করে এবং আমাদের জানা রূপে সংহত করে। আমি জানি না কোন দার্শনিক স্বপ্নেও ভেবেছেন কি না একটা কোম্পানি সেন্সরি রিয়েলিটি হোম ডেলিভারি দিবে।

শিল্পের মধ্যে গান আধুনিক ধরণে স্থানান্তরের সবচেয়ে উপযোগী। এটার প্রকৃতি, আর আমাদের চেনা জগতে এর পোক্ত অবস্থানের দরুন এর প্রবাহ, পুনরুৎপাদন এমনকি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও প্রথম রূপান্তর ঘটবে। সব শিল্পের মধ্যে এটার চাহিদা বেশি, আমাদের সামাজিক অস্তিত্বে সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ত, জীবন ঘনিষ্ট, এটা জীবনের আদত তৎপরতায় প্রাণ সঞ্চার করে, সহযোগী হয় কিংবা জীবনকে নকল করে। আমাদের জীবনের ঐহিক জীবনপ্রবাহে কথা বলা হোক কিংবা হাঁটা, ধ্যান কিংবা তৎপরতা, একঘেয়েমি কিংবা তাজ্জব হওয়ার পর্ব, সর্বত্রই গান আমাদের ছুঁয়ে যেতে পারে, এ কাজগুলোর গতি আর সংবেদন সব একীভূত আর আকারান্তর করে। এটা আমাদের বাস্তব জীবনের চাবিগুলো আলতো ছুঁয়ে  দিয়ে আমাদের জন্য এক বানানো সময় বুনে দিতে পারে। আমরা এটায় অভ্যস্ত হয়ে যাই, আমরা নিজেদের এর কাছে সমর্পিত করে দিই স্বেচ্ছায় এমন করে, যেমন করে কেউ থমাস দ্য কুইন্সি’র ‘পরিমিত, সূক্ষ্ম এবং কড়া’ সাবস্ট্যান্সের কাছে সমর্পণ করে। যেহেতু, এটা সরাসরি আবেগের কলকব্জা ধরাশয়ী করে ফেলে, মানে আবেগ নিয়ে যথেচ্ছা খেলে, সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করে, ফলে এটা অন্তঃসার বিচারে সার্বজনীন, এটা কানে আরাম দেয় আবার মানুষকে নাচায়, বিজ্ঞানের মতই এটা সকল জাতিরই চাহিদা আর পণ্যে পরিণত হয়। এ অবস্থা যদি প্রবাহের উপায়ে সাম্প্রতিক উন্নতি খেয়ালে রেখে বিচার করি, তাহলে দুইটা প্রযুক্তিগত প্রশ্ন সামনে আসে— ১. পৃথিবীর যেকোন জায়গায় তৎক্ষণাৎ শোনা যাবে, এরকম এক গান বানানো, কোথায় এটা পারফর্ম হল তা মাথায় না রেখেই। ২. যেকোন জায়গায় যেকোন সময়ে ইচ্ছেমত একটা গান পুনরুৎপাদন। এ সকল সমস্যার সমাধান হয়েছে। আর সমাধানগুলাও দিনকে দিনকে আরো শীলিত মার্জিত হচ্ছে। একই মাত্রায় আমরা ভিজুয়াল ফেনমেনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। …সুরের মায়ার যে শক্তি, তার মত করে প্রশান্ত মহাসাগরে একটা সূর্যাস্ত, মাদ্রিদের আকাশে টাইটান– এখনও আমাদের বসার ঘরে বসে উপভোগ করা যাচ্ছে না।

একদিন সেটা ঘটবে। সেদিন (ওরা) ভালই করবে, আর সমুদ্রতলে কি চলছে তাও কোনও না কোনভাবে দেখিয়ে দিতে পারবে। তবে, শব্দ, রব, স্বর, স্বনতার যত জগত, সব আমাদের। আমরা যখন যেখানে চাই তাদের শুনতে পারি। আগে আমরা নিজেদের সময়ে, নিজেদের মুড মাফিক গান উপভোগ করতে পারতাম না। কোন একটা উপলক্ষ, একটা স্থান, একটা তারিখ আবার একটা প্রোগ্রামের উপর আমাদের আনন্দ নির্ভর করতম। কত কাকতাল যে লাগত! আজকে আমরা আনন্দের ঠিক উলটো শৃঙ্খল থেকে মুক্ত, কাজে কাজেই গানের সংবেদনশীল রসাস্বাদন থেকেও। আনন্দের সময় বেছে নেয়া, আনন্দকে পূর্ণ উপলব্দি- কেবল যখন আমাদের মন চায় তখন না, আমাদের রূহ আর সমগ্র সত্তা আকুলি বিকুলি করে যখন, ভেবে রাখা আগে ভাগেই যে কি ঘটতে যাচ্ছে– এ যে কর্মকান্ড এটার মানে হল কম্পোজারের অভিপ্রায় পূর্ণ বিস্তারের সুযোগ দেয়া, কারণ এক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টি একটা প্রাণবন্ত পরিবেশে সজীব সপ্রাণ হয়ে উঠে, যা তখন যেখানে ঐ সৃষ্টির তৈয়ারি, সে পরিবেশ থেকে ভিন্ন না। রেকর্ড হওয়া গানে কম্পোজার অথবা পারফর্মারের কাজ সবেচেয়ে নিখুঁত নান্দনিক ফসলের জরুরি পূর্বশর্ত খুঁজে পায়। আমার এখন মনে পড়ছে, এক বিদেশি নাট্যমঞ্চে একটা রূপকথা ধরনের নাটক দেখেছিলাম। অথবা ধরেন, এটা আমার কল্পনা। যাদুকরের প্রাসাদে ফার্নিচার কথা বলে, গায় আবার একটা কাব্যিক আর দুষ্টু ভূমিকায় কাজ করে। দরজা খোলার সাথে গ্রাম্য এক ব্যান্ডের বাঁশি কিংবা গম্ভীর সুর বাজে। কেউ গদিতে বসল তো এটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে। একটু স্পর্শেই সবকিছু গীত করা শুরু করে ।

আমি মনেপ্রাণে ভাবতে চাই, আমরা শব্দ যাদুর সেরকম বাহুল্যের দিকে এগুচ্ছি না। এখনই একটা ক্যাফেতে বসলে কনসার্টের বিরক্তিতে টেকা যায় না। কিন্তু, এটা নিদারুন সুখের হবে, যদি ইচ্ছেমতন একটা অলস ঘন্টা, একটা একঘেয়ে সন্ধ্যা, একটা ক্লান্তিকর রবিবার কে একটা যাদুময়তা, কোমল অভিব্যক্তি, ভাবের উড়ানে রূপান্তরিত করে দেয়া যায়। ধরেন, দিনগুলো রঙহীনা, অনেক নারী-পুরুষ তো খুব একা, আবার অনেকের জন্য বয়স কিংবা জরার কারণে নিজের সাথেই বসবাসের স্বাচ্ছন্দ্য বেছে নিতে হচ্ছে। এই যে মানুষগুলো, বিষণ্ণ ও ক্লান্ত, তারা এখন নিজেদের দুখী আর বেহুদা সময় সৌন্দর্য আর উষ্ণ আবেগ দিয়ে ভরিয়ে ফেলতে পারবে। গান আর পদার্থবিদ্যার নতুন মাখামাখির প্রাথমিক ফল হল এইসব। এ দুইয়ের চিরন্তন সম্বন্ধ আমাদের ইতোমধ্যে বহুত কিছুদিয়েছে। আরো অনেক কিছু দেখব।

তরজমাঃ মাহফুজ আলম, লেখক ও গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।