পটভূমিঃ লু স্যুন ও তাঁর বন্ধু ফ্যান আইনং
দুনিয়ার সাহিত্যসংসারে চৈনিক লেখক লু স্যুনের (১৮৮১—১৯৩৬) নাম সুবিদিত। জীবনকাল সংক্ষিপ্ত হলেও তাঁর কর্মপরিসর ছিল বহুবিস্তৃত। এই স্বল্প পরিসরে সে আলোচনার সূত্রপাত ঘটানোর সুযোগ নেই। যেই গল্প আমরা তরজমার দুঃসাহস দেখিয়েছি সেই গল্পের পটভূমি নিয়ে বরং দুয়েক কথা বলা যেতে পারে।
‘শুঁড়িখানা’য় গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালের ২৫ মে তারিখে, সাংহাইয়ের ‘দ্য শর্ট স্টরি ম্যাগাজিন’ নামক একটি সাময়িক পত্রিকায়। যদিও গল্পের নিচে উল্লেখিত তারিখ থেকে বোঝা যায় তিনি গল্পটি লেখা শেষ করেছিলেন একই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। এই গল্পের আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত পুরোটা জুড়েই লেখক স্বয়ং হাজির। আর আছেন তাঁর এক পুরনো বন্ধু, গল্পে যার নাম উই—ফু। উত্তরকালের গবেষকরা জানাচ্ছেন, এই উই—ফু আসলে তারই স্বল্পায়ু বন্ধু ফ্যান আইনং, যিনি মারা গেছেন এই গল্প লেখার এক যুগ আগে, ১৯১২ সালে। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত লু স্যুনের স্মৃতিকথার সংকলন ‘সন্ধ্যায় তুলে ফেলা সকালের ফুল (ডন ব্লজমস প্লাকড এট ডাস্ক)’ থেকেও এর সত্যতা মিলে। এই গ্রন্থের ‘ফ্যান আইনং’ শীর্ষক লেখায় যে মানুষটিকে পাওয়া যায় তার সাথে মিল রয়েছে উই—ফুর।
ফ্যান আইনংয়ের (১৮৮৩—১৯১২) সাথে লু স্যুনের পরিচয় ঘটে ১৯০৭ সালে, জাপানের টোকিওতে। দুইজনই তখন বিদ্যাশিক্ষার জন্য জাপানে অবস্থান করছেন। ফ্যান আইনং ছিলেন শাওশিংয়ের বিপ্লবী সু সি—লিনের ছাত্র। সু সি—লিনই ১৯০৫ সালে ফ্যান আইনংকে জাপানে নিয়ে আসেন। নবীন শিক্ষার্থীদের আসার খবর পেয়ে লু স্যুন তাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলেও ফ্যান আইনংকে তিনি আলাদাভাবে খেয়াল করেননি। তার দুই বছর পর ১৯০৭ সালে চীন থেকে আগত এক টেলিগ্রাম মারফত লু স্যুন ও অন্য ছাত্ররা জানতে পারেন, আনহুই প্রদেশের গভর্নর এনমিংকে হত্যা করা হয়েছে এবং হত্যাকারী সু সি—লিনকে আটক করা হয়েছে।
এর কয়েকদিন পরই এক বর্বরতম খবর আসে: সু সি—লিনের কলিজা খুলে আগুনে পুড়িয়ে খেয়েছে এনমিংয়ের দেহরক্ষীরা। এই খবর শুনে ক্ষুব্ধ হয় লু স্যুন ও জাপানে অবস্থানরত অন্য শিক্ষার্থীরা। একজন প্রস্তাব করেন, মানচু সরকারের এই বর্বরতা সম্পর্কে পিকিংকে অবহিত করতে এবং এই ঘটনার তদন্তের দাবি জানিয়ে তারা পিকিং বরাবর একটি টেলিগ্রাম পাঠাতে পারে। এই প্রস্তাবে এক দল রাজি হয়, আরেক দল রাজি হয় না। লু স্যুন ছিলেন টেলিগ্রাম পাঠানোর পক্ষে। এই বাদানুবাদের মাঝখানে হঠাৎ একজন বলে ওঠে: ‘যাদেরকে মারা হয়েছে তাদেরকে তো মারাই হয়েছে, যারা মারা গেছে তারা তো মারাই গেছে, এখন আর এইসব ঝামেলা বাধানোর টেলিগ্রাম পাঠানোর কি মানে আছে!’
লু স্যুন তার সহপাঠীদের জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, এই বক্তব্য প্রদানকারীর নাম ফ্যান আইনং, যিনি সু সি—লিনের শিষ্যদের একজন। গুরুর মৃত্যুতে শিষ্যের এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্যে ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত হন লু স্যুন। যার ফলে বহুদিন পর্যন্ত ফ্যান আই—নংয়ের প্রতি তার ঘৃণা জারি ছিল। যদিও ফ্যানের সাথে লু স্যুনের পুনরায় দেখা হয়, প্রায় চার বছর পর, ১৯১১ সালের বিপ্লবের প্রাক্কালে। এবারের দেখা হওয়ার উপলক্ষ্য অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক বন্ধুর বাসায় মদ্যপান করতে গিয়ে কাকতালীয়ভাবে তাদের দেখা হয়ে যায়। মজার বিষয় হলো, এই দেখায় তারা দুজনই আগেকার সেই রেষারেষি ভুলে যান। তারা দুজনই দুজনকে ভালোভাবে গ্রহণ করেন। দ্রুতই তারা একে অপরের আড্ডা, মদ্যপান, সুখ—দুঃখের সঙ্গী হয়ে ওঠেন। দুইজন একই স্কুলে চাকরিও করেন কিছুদিন: ল্যু সুন ছিলেন অধ্যক্ষ, আর ফ্যান আইনং সুপারভাইজর। এ সুবাদে ফ্যানের জীবন কিছুদিন বেশ স্থিতিশীল কাটে। তার চেহারাসুরত ও জীবনযাপনে পরিবর্তন আসে, তার মদ্যপান কমে যায়, একজন নিবেদিতপ্রাণ চাকরিজীবী হয়ে ওঠে সে। কিন্তু এই স্থিতিশীল সময় ফুরিয়ে আসতে খুব বেশি সময় লাগে না।
শাওশিংয়ে একটি পত্রিকা প্রকাশকে কেন্দ্র করে বেশকিছু ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন লু স্যুন। একসময় তাকে বদলি করা হয় নানকিংয়ে। কিছুদিন নানকিংয়ে চাকরি করার পর তাকে পাঠানো হয় পিকিংয়ে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। লু স্যুন শাওশিং ত্যাগের পর তাঁর জায়গায় নিয়োগ দেয়া হয় কনফুসিয়ান লিগের এক সদস্যকে। নতুন অধ্যক্ষ আসার কিছুদিনের মাথায় চাকরি যায় ফ্যানের। তার জীবনে ধীরে নেমে আসে অসীম দুর্দশা। কিছুদিন বন্ধুর বাড়িতে থাকেন তো কিছুদিন থাকেন পথে পথে। তার মদ্যপান বেড়ে যায়। চেহারা—সুরত ও জীবনযাপনে নেমে আসে আগেকার মলিনতা। এই করে তার কিছুদিন কাটে। কিন্তু দুর্দশাকে কাটিয়ে জীবনে সফল হওয়ার যে প্রক্রিয়া সেই প্রক্রিয়ায় প্রবেশের আগেই একদিন বন্ধুবান্ধবের সাথে মদ্যপ অবস্থায় অপেরা থেকে ফেরার পথে নৌকা থেকে পড়ে মাত্র ২৯ বছর বয়সে প্রাণ হারান ফ্যান আইনং।
তাঁর এই মৃত্যু আত্মহত্যা নাকি স্বাভাবিক মৃত্যু এ নিয়ে দ্বিধা ছিল লু স্যুনের মনে। লু স্যুনের একটা অনুমান হলো ফ্যান আত্মহত্যাই করেছে; কেননা, লু স্যুনের মতে, সে ছিল একজন দুর্দান্ত সাঁতারু। তার পক্ষে আর যাই হোক পানিতে ডুবে মৃত্যু অস্বাভাবিক।
ফ্যানের কাছে সবসময়ই ভরসার জায়গা ছিল লু স্যুন। তাঁর সবসময়ই মনে হতো লু স্যুন তাঁর জন্য পিকিংয়ে কোনো একটা চাকরিবাকরির ব্যবস্থা করবে। লু স্যুন অবশ্য চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় সে চেষ্টা সফল হয়নি। মারা যাওয়ার সময় ফ্যান ছিলেন কপর্দকশূন্য দশায়। তাঁর স্ত্রী ও শিশুকন্যাটির জন্য বড় আফসোস করতে দেখা গেছে লু স্যুনকে। মেয়েটির লেখাপড়ার জন্য এক তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেয় কয়েকজন মিলে। কিন্তু এই তহবিল কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে সেই বিতণ্ডায় তহবিলটি আর আলোর মুখ দেখেনি। এ নিয়েও দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায় লু স্যুনকে। বোঝা যায়, বন্ধুর অকালবিয়োগ এবং দুর্দশাকালে বন্ধুর জন্য কিছু করতে না পারার বেদনা প্রতিনিয়তই লু স্যুনকে দগ্ধ করেছে। সেই যাতনাই সম্ভবত তাঁর লেখালেখির কেন্দ্রে বার বার নিয়ে এসেছে ফ্যানকে।
ফ্যানকে বাঁচতে দেয়নি তাঁর নিষ্ঠুর সমাজ আর তার স্বভাবজাত সারল্য। মুখ ও অন্তরের মধ্যে পার্থক্য করা শিখতে পারেননি ফ্যান। তাঁর পক্ষে শেখা সম্ভব হয়নি ছলনা, যেই ছলনার উপর আশ্রয় করে টিকে থাকে সমাজ ও সেই সমাজের নানা স্তরের মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক। ছলনা রপ্ত করতে পারেনি বলে কোথাওই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারত না ফ্যান। সর্বত্রই সে ছিল অনুপযুক্ত। শ্রেণি, শিক্ষা, আমলাতান্ত্রিক অবস্থান, বয়স ও ধন—সম্পদগত যে ভেদাভেদ তার সমাজে বিদ্যমান ছিল তা কখনো আমলে নিতেন না ফ্যান। এসব তার মাথায় কখনো কাজই করত না।
ফ্যানের এক শ্রেণিভেদজ্ঞানহীনতা বুঝতে একটা ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। যেই মিলিটারি গভর্নরের আমলে ফ্যান ও লু স্যুনের চাকরি হয়েছিল তার নাম ছিল ওয়াং জিনফা। ঘটনাক্রমে তিনিও ছিলেন ফ্যানের গুরু সু সি—লিনের শিষ্য। সে সুবাদে দু জনের মধ্যে সামান্য চিন—পরিচয় ছিল। কিন্তু এমন কোনো বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল না। একদিন ওয়াং সাহেবের অফিসে গিয়ে ফ্যান তাকে ‘পুরানা বন্ধু’ হিসেবে সম্বোধন করতে লাগল। শুধু তাই না, ওয়াং সাহেবের মুণ্ডিত মাথা দুই হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে বললো, বন্ধু তুমি তো ভালোই উন্নতি করছো, এ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য তোমাকে অভিনন্দন।
ফ্যানের এই ভেদাভেদজ্ঞানহীনতা ও সরলতাই লু স্যুনকে মুগ্ধ করেছিল বলে ধারণা করেন অনেকে। কারণ, সমাজে বিদ্যমান যে আধিপত্যপরম্পরা (হায়ারার্কি) একেই চীনা সমাজের মৌলিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন লু স্যুন। ফ্যানের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিতে একাধিক কাব্য রচনা করেন লু স্যুন। তার মধ্যে একটি কবিতার কয়েক চরণ স্মরণ করা যাকঃ
‘যখন জমিনের উপর দিয়া ঝড় বয়ে যায়
স্মৃতির চক্ষু তখন ফ্যান আই—নংয়ের দিকে ধায়:
ধূসর চুল, আলুথালু, পাতলা পাতলা,
ঘৃণায় ভরে উঠছে চোখের শ্বেতমণ্ডল
পদ—পদবির লাগি ঘোঁৎঘোঁৎ করতে থাকা পা—চাটাদের দেখে দেখে।
যেই খাবারের স্বাদ তিতা
চিরকালই দুনিয়ার কাছে তা না—পছন্দ
যেই মানুষের মত ও পথ সরলসিধা
তারে বেশিদিন বরদাস্ত করবে না ভয়াল দুনিয়া।
তারপরও, কে জানতো
আমাদের বিচ্ছেদের মাত্র তিন মাসের মাথায়
এই ভয়াল দুনিয়া ছেড়ে তুমি চলে যাবা
যেখানে কোনোদিন নিজেরে তুমি মানাইয়া নিতে পারো নাই?’
কিছু কিছু স্থান থাকে যেখানে মানুষ আর ফিরতে চায় না। ফিরলে কেবলই বেদনা বাড়ে। তারপরও কোনো এক অলৌকিক কারণে সেখানে তার ফিরতে হয়। এক যুগ পর শাওশিংয়ে ফেরার ব্যাপারটি লু স্যুনের জন্য তেমনই ছিল। এখানে ফেরার পর তাকে জেঁকে ধরে ফ্যান আইনংয়ের স্মৃতি। তারপর পুরোনো সেই শুঁড়িখানা, যেখানে বহুরাত মদ পিয়ে আর আড্ডা দিয়ে পার করেছে লু স্যুন ও তাঁর প্রয়াত বন্ধু ফ্যান আইনং।
উই—ফুর মুখ দিয়ে লু স্যুন যেসব কথা বলিয়েছেন আদতে দেখা যায় সেসব তারই সকল চিন্তা বা দুশ্চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। কারণ ফ্যান আইনং তার মা—বাবাকে হারিয়েছেন খুবই ছোটবেলায়। দাদা—দাদীর কাছেই সে মানুষ। তাকে আর্থিক সহায়তা দিত তার এক চাচা; যদিও জাপানে পড়াশুনারত অবস্থায় এক পর্যায়ে তার চাচা অর্থকড়ির যোগান দেয়া বন্ধ করে দেন। অর্থাভাবে শেষপর্যন্ত লেখাপড়া শেষ না করেই তাকে চীনে ফিরে আসতে হয়। কিন্তু গল্পের প্রোটাগনিস্ট হিসেবে যে উই—ফুকে আমরা পাই তাঁকে দেখা যায়, সবসময় তার মধ্যে মাকে খুশি করার একটা বাসনা বিদ্যমান। মাকে খুশি করার জন্য সে মিথ্যা বলে, অভিনয় করে, যা ঘটার নয় তাই ঘটায়। মায়ের প্রতি লু স্যুনের যে ভক্তি ছিল এবং মাকে খুশি করার যে বাসনা ছিল তা—ই তিনি সম্ভবত মূর্ত করার প্রয়াস পেয়েছেন উই—ফুর মধ্য দিয়ে।
লু স্যুনের মৃত্যুর পর, ১৯৩৭ সালে প্রদত্ত এক ভাষণে তৎকালীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সেতুং বলেছিলেন: ‘কনফুসিয়াস যদি প্রাচীন চীনের সিদ্ধপুরুষ হয়ে থাকেন তবে আধুনিক চীনের মহান সিদ্ধপুরুষ হলেন লু স্যুন।’ প্রশ্ন হলো, আপসপ্রবন উই—ফুকে নিয়ে কেন গল্প লিখলেন চীনের মহান বিপ্লবী মাও সেতুংয়ের নয়নের মণি লু স্যুন? এই প্রশ্নের উত্তর জানতেই পড়া যেতে পারে ‘শুঁড়িখানা’য় গল্পটি। ব্যক্তি যে কেবল আশাবাদের মধ্যেই থাকতে পারে না, জীবনের নানা ঘটনা যে নানাভাবে তাকে দাগা দিয়ে যায় তা—ই মূলত এই গল্পের ছত্রে ছত্রে আমরা দেখতে পাবো।
ধারণা করি, বিপ্লবকেন্দ্রিক আশাবাদের মধ্যে ব্যক্তির নিজের আশাবাদী হওয়ার যে ব্যাপার তা নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশাগ্রস্ত ছিলেন লু স্যুন। এক লেখায় তিনি জানাচ্ছেন: ‘আশা হইল সেই বস্তু যারে আপনি ভাবতে পারেন আছে অথবা নাই। আশা হইল বিরানমাঠের মাঝখান দিয়া বহমান সেই পথটার মতো, যার শুরু কিভাবে হইল কেউ জানে না, যখন বহু লোক একইভাবে একই গন্তব্যের দিকে আগাইয়া গেল তখনই শূন্য মাঠে একটা পথ মূর্ত হইয়া উঠল।’ বহুলোকের হেঁটে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট পথ দিয়ে ব্যক্তি যখন একা হেঁটে যায় তখন সমষ্টির আশা কি ব্যক্তির মাঝে সদা দেদীপ্যমান থাকে? নাকি ব্যক্তির হাঁটার পথ সবসময়ই অন্ধকারময়, নৈরাশ্যপূর্ণ? ব্যক্তিগত জীবন, আশা—নৈরাশার দোলাচল, সমষ্টির মাঝে ব্যক্তির বলি হওয়া এসবও তো নাকচ করার উপায় নেই। লু স্যুনের লেখাজোখায় নানা ছুতায় প্রায়ই প্রকটিত হয় ব্যক্তির এইসব সংকট।
তরজমা প্রসঙ্গে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) যুগে আলাদা করে অনুবাদের হয়ত আর প্রয়োজন পড়বে না। কিছুদিন পরই এআই—ই আমাদের সামনে অর্থ হাজির করে দিবে। আমরাই হয়ত শেষ প্রজন্ম যারা কিনা এই সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছি। অনাগত দিনে এই শিল্পের ভার মানুষের হাতে আর থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। আমাদেরও প্রিয় পেশাটি দুনিয়া থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এই হতাশার মুহূর্তেও একটা জায়গায় একটু আশার আলো এখনো দেখতে পাই। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হয়ত আমাদের দেখাতে পারবে একজন লেখক কি লিখেছে। কিন্তু সেই লেখার পেছনে অনুভূতির যেই খেলা তা সম্ভবত এআইর পক্ষে কোনোদিন আবিষ্কার করা সম্ভব হবে না; কেননা মানবজীবনের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করা তো আর তার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না।
এক মানুষ যখন আরেক মানুষের লেখা তরজমা করে তখনো তো অনেককিছু হারিয়ে যায়, নাহয় তো ‘লস্ট ইন ট্রান্সলেশন’ শব্দবন্ধের আগমন ঘটত না। এই তরজমার ক্ষেত্রেও নিঃসন্দেহে এই কথা সত্য। চীনা ভাষায় অপরাগতা হেতু মূল ভাষা থেকে এ অনুবাদ করা সম্ভব হয়নি। অনুবাদের জন্য আশ্রয় নেওয়া হয়েছে ইংরেজি অনুবাদের। অনুবাদ থেকে অনুবাদের ফলে হয়ত মূলের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। তারপরও অনুবাদক হিসেবে চেষ্টা করেছি লেখক কি লিখছেন শুধু তাতে গুরুত্ব না দিয়ে কিভাবে লিখছেন বা কোন অনুভূতি পশ্চাতে খেলা করেছে তা বোঝার।
যতদূর জানি লু স্যুন ছিলেন তার গুরু নিকোলাই গোগলের মতই স্টাইলিস্ট, যার ফলে তার বক্তব্য প্রদানের ধরনে রয়েছে বিশেষ ভিন্নতা। তিনি কি বলছেন শুধু তা—ই গুরুত্বপূর্ণ নয় কিভাবে বলছেন তাও গুরুত্বপূর্ণ। সেই জায়গাগুলো বোঝার প্রয়াস পেয়েছি। কোথাও কোনো ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে আশা করি পাঠক তা ধরিয়ে দিবেন।
(তরজমাকার)
গল্প
উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণপূর্ব দিকে সফরকালে ঘুরপথে একবার বাড়ির দিকেও গেলাম, তারপর আসলাম ‘শ’-তে। ‘শ’ শহরটি আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র দশ মাইল দূরে; ছোট ডিঙ্গিযোগে আধাদিনেরও কম সময়ে এই শহরে পৌঁছা যায়। এখানকার একটা স্কুলে আমি এক বছর পড়িয়েছি। বরফ কেটে যাওয়ার পর এখানে এখন তীব্র শীত। প্রকৃতি বিষণœ। ‘লো স্যু’ নামে একটা হোটেলের দেখা পেলাম। আলস্য আর স্মৃতিকাতরতা মিলিয়ে মনে হলো, আপাতত এখানেই ওঠা যাক। আমি যখন এখানটায় থাকতাম তখন অবশ্য এ হোটেলটা দেখিনি। শহরটাও তখন আরো ছোট ছিল।
মনে মনে পুরানা কলিগদের খোঁজ করতে লাগলাম। ভাবছিলাম, হয়ত কারো না কারো দেখা পেয়ে যাব। কিন্তু কারোই দেখা পাওয়া গেল না। বহু আগেই তারা নানা দিকে ছড়িয়ে গেছে। স্কুলের গেইটটা পার হতেই দেখি, এর নাম চেহারা সব বদলে গেছে। এই দৃশ্য দেখার পর নিজেকে একদমই আগন্তুক মনে হলো। দুই ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে আমার যাবতীয় উৎসাহ ফুরিয়ে গেল। কেন আসলাম ভেবে নিজেকেই নিজে ভর্ৎসনা করতে লাগলাম।
যে হোটেলটায় উঠলাম তারা শুধু থাকার ঘরটাই দিলো, খাবারের কোনো ব্যবস্থা করল না। ভাত ও অন্যান্য খাবার চাইলে বাইরে থেকে আনিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু সেগুলো পুরোপুরি অখাদ্য, স্বাদে মাটির লাহান। জানালার ওপারে শুধু শুকনো শেওলায় ঢাকা একটা পাংশুল দেয়াল। উপরে ধূসর আকাশ, রংহীন বিবর্ণ। হালকা তুষারপাত শুরু হয়েছে। দুপুরের খাবারটা খুব বাজে ছিল। এদিকে সময় কাটানোর কোনো উপায় পাচ্ছি না। এখানে থাকার সময় ‘এক পিপা ঘর’ নামে একটা অখ্যাত শুঁড়িখানায় আমার বেশ গতায়াত ছিল। হোটেল থেকে খুব একটা দূরে হওয়ার কথা না। ভাবলাম সেখানেই যাওয়া যাক। দরজা বন্ধ করে দ্রæতই শুঁড়িখানার উদ্দেশে বের হয়ে পড়লাম। আসলে আমি কেবল চাচ্ছিলাম একঘেয়েমি থেকে রেহাই পেতে। মদ্যপানের কোনো উদ্দেশ্য আমার ছিল না।
ভাগ্য সুপ্রসন্ন। ‘এক পিপা ঘর’ এখনো আছে। এর সরু, জীর্ণশীর্ণ সম্মুখভাগ আর মরিচাধরা সাইনবোর্ডটি এখনো আগের মতোই আছে। কিন্তু মালিক থেকে শুরু করে ওয়েটার পর্যন্ত একটা লোককেও চিনতে পারলাম না। এখানেও আমি পুরোপুরি আগন্তুকে পরিণত হলাম। তারপরও ঘরের কোনার সেই পরিচিত সিঁড়িটি বেয়ে উপরতলার ছোট কক্ষটিতে উঠে আসলাম। কাঠের ছোট পাঁচটি টেবিল এখনো আগের মতই আছে। শুধু পেছনের জানালাটায় কাঠের জালি পাল্টিয়ে কাঁচের শার্সি লাগানো হয়েছে।
ওয়েটারকে বললাম, ‘এক ক্যাটি হুয়াংজিয়ু, দশ ¯øাইস টফু আর বেশি করে পিপার সস।’ অর্ডার করে পেছনের দিকটায় গিয়ে জানালার পাশের টেবিলটায় বসলাম। উপরতলার এ কামরাটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। ফলে নিচের জনশূন্য আঙ্গিনাটা যে টেবিল থেকে সবচেয়ে ভালো দেখা যায় সহজেই গিয়ে সেখানে গিয়ে বসতে পারলাম। এ ফাঁকা জায়গাটা সম্ভবত এ দোকানের না। অতীতেও বহুবার এ টেবিলটায় বসে আমি এ আঙ্গিনার পানে চোখ রেখেছি, কখনো কখনো তুষারাবৃত আবহাওয়াতেও। আমার চোখে এখনো উত্তরাঞ্চল ভাসছে, তারপরও জানলা দিয়ে বাহিরের দৃশ্য বেশ আকর্ষণীয় লাগলো; বরফের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে কিছু বরই গাছ। নতুন কুঁড়িতে সতেজ গাছগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেন এই তীব্র শীতকে তারা থোড়াই কেয়ার করছে। জীর্ণশীর্ণ চাতালটার পাশে এখনো রয়েছে একটি ক্যামেলিয়া গাছ। তুষারমাঝে অগ্নিকুÐের মতো জ্বলজ্বল করছে গাছটার ভারী-গাঢ়সবুজ পাতার উপর ফুটে থাকা ডজনখানেক রক্তবর্ণ অত্যুগ্র উদ্ধত ফুল। যেন এক পর্যটকের ভ্রমণতৃষাকে তারা অকাতরে উপহাস করছে। আমার হঠাৎ এখানকার জমাটবাঁধা বরফের আর্দ্রতার কথা মনে পড়ল। এখানকার বরফ উত্তরের শুকনো বরফ থেকে আলাদা: জমাটবাঁধা, ঝকঝকে ও উজ্জ্বল। খুব বাতাস হলে উত্তরের বরফ উড়তে থাকে এবং কুয়াশার মতো আকাশে ছড়িয়ে পড়ে…
এরই মধ্যে ওয়েটার এসে অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘আপনার ওয়াইন, স্যার…।’ বলেই সে টেবিলে একে একে পেয়ালা, চপস্টিক, পানপাত্র ও খাবার নামিয়ে দিল। শরাব এসে গেছে দেখে টেবিলের দিকে ঘুরলাম। সব ঠিকঠাক করে পেয়ালায় মদ ঢাললাম। আমার মনে হয়েছিল উত্তর আসলে আমার জন্য উপযুক্ত জায়গা না। কিন্তু দক্ষিণে এসেও আমার নিজেকে আগন্তুকই মনে হলো। উত্তরের পাউডার-সদৃশ শুকনো বরফ আর এখানকার দীর্ঘক্ষণ জমাট বেঁধে থাকা কোমল বরফ আমার কাছে একই রকম অচেনা ঠেকতে লাগলো। কিছুটা মনমরা ভাব নিয়ে আস্তেধীরে মদের পেয়ালায় একটা চুমুক দিলাম। মদটা ছিল একদম খাঁটি, আর টফুটাও খুব ভালোমত ভাজা হয়েছে। একমাত্র দুঃখের বিষয় হলো, মরিচের সসটা খুব হালকা। হাহ, শহরের লোকগুলা কড়া ঝাঁঝের মজাটা কোনোদিন বুঝতে পারল না!
সম্ভবত বিকেল হওয়ার কারণে এখানে পানশালার ভাবটা এখনো আসেনি। এর মধ্যে তিন পেগ মদ খেয়ে ফেললাম। কিন্তু আশেপাশে চারটা খালি চেয়ার ছাড়া আর কারো দেখা পেলাম না। ফাঁকা মাঠটার দিকে তাকিয়ে নিঃসঙ্গ বোধ করতে লাগলাম। তারপরও আমি চাচ্ছিলাম না আর কোনো খরিদ্দার এসে ভিড় করুক। সিঁড়ি ভেঙ্গে কেউ একজন উঠে আসছে মনে হলো। তার পায়ের শব্দে বেশ বিরক্ত হচ্ছিলাম। কিন্তু শেষমেশ যখন দেখলাম এ আর নতুন কেউ নয়, বরং এখানকার ওয়েটার, তখন বেশ স্বস্তি বোধ করলাম। তারপর আরো দুই পেগ মদ মেরে দিলাম।
কিন্তু এইবার মনে হচ্ছে আর রক্ষা নেই। পায়ের শব্দ শুনে মনে হলো, এইবার নিশ্চয়ই কোনো কাস্টমার। কারণ, লোকটা ওয়েটারের চেয়ে ধীরে পা ফেলছিল। একসময় বুঝতে পারলাম লোকটা উপরে উঠে এসেছে। অনেকটা আশঙ্কা নিয়ে অনাকাঙ্খিত সেই সঙ্গীর দিকে উঁকি মারলাম। লোকটারে দেখে রীতিমতো ভিমড়ি খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমি কখনো ভুলেও ভাবি নাই এখানে কোনো বন্ধুর দেখা পেয়ে যাব Ñ অবশ্য লোকটা যদি আমার ‘বন্ধু’ বলাটাকে অনুমোদন করেন। এই লোকটা ছিলেন আমার এককালের সহপাঠী। শিক্ষকতা করার সময়ও তাকে আমি সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি। দেখার পরপরই খেয়াল করলাম, আমি তাকে সর্বশেষ যেমন দেখেছিলাম তার তুলনায় সে খুব একটা বদলায় নাই। শুধু চলার গতিটা ধীরস্থির হয়ে পড়েছে। আগেকার সেই চঞ্চল ও চটপটে লু উই-ফুর সাথে তার যেন মিল নাই।
‘আহ্, তুমি উই-ফু না? এখানে তোমার দেখা পাব একদমই ভাবি নাই।’
‘আরে তুমি? আমিও একেবারেই ভাবি নাই …’
উই-ফুকে আমার টেবিলে বসতে বললাম। বসবে কি বসবে না সংকোচ করতে করতে সে বসল। তার এই সংকোচ করার বিষয়টা প্রথমে আমি নিতে পারছিলাম না। তার এমন আচরণে কিছুটা কষ্ট পেলাম, বিরক্তও হলাম। ভালমতো তাকানোর পর খেয়াল করলাম, তার চুল-দাঁড়ি-গোফ এখনো আগের মতোই অগোছালো, মুখটা আয়ত বিষণœ; তবে আগের চেয়ে শুকনা ও রোগাসোগা। তাকে খুব চুপচাপ দেখাচ্ছিল, কিংবা বিষাদগ্রস্ত। কালো মোটা ভুরুর নিচে চোখজোড়ায় আগের সেই তৎপরতা আর নেই। স্কুলে পড়ানোর সময় তার চোখে প্রায় সবসময় একটা তীক্ষè চাহনি ফুটে উঠতে দেখতাম। পাশের শূন্য মাঠটার দিকে তাকানোর পর হঠাৎ মনে হলো তার চোখ ঠিকরে পড়ছে সেই পুরনো চাহনি।
ইচ্ছা না করলেও হাসিমুখে তাকে বললাম, ‘প্রায় দশ বছর আমাদের দেখা নাই। অনেকদিন আগে শুনেছিলাম তুমি সিনানে আছ, কিন্তু আলস্যবশত তোমাকে চিঠিপত্র লেখা হয়নি…’
সে বলল, ‘আমারও একই অবস্থা। দুই বছরের বেশি হয় মায়ের সাথে তাইওয়ানে আছি। মাকে আনার জন্য যখন ফিরে গেলাম তখন জানতে পারলাম তুমি এরই মধ্যে চলে গেছ, একেবারে চলে গেছ।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাইওয়ানে কি করছ?’
‘এখানকার একটা রাজপরিবারে পড়াচ্ছি।’
‘তার আগে কি করতে?’
‘তার আগে?’ বলেই সে পকেট থেকে একটা সিগারেট নিল, সিগারেটটা জ্বালিয়ে মুখে নিল, তারপর মুখ থেকে বের হওয়া কুÐুলিপাকানো ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে চিন্তামগ্নভাবে বলল, ‘একদমই অর্থহীন কাজ, কিছুই না করার মতো।’
এবার সে আমার বিষয়ে জানতে চাইলো। জানতে চাইলো, সবাই দলছুট হয়ে পড়ার পর থেকে এখন অবধি কি করলাম টরলাম। আমি তাকে একটা খসড়া ধারণা দিলাম। একই সঙ্গে ওয়েটারকে বললাম আরেকটা কাপ ও চপস্টিক নিয়ে আসতে। আরো দুই ক্যাটি গরম মদ আমাদের জন্য অপেক্ষমান। আমরা খাবারও অর্ডার করলাম। অতীতে আমাদের মধ্যে ফর্মালিটি ব্যাপারটা একদমই ছিল না, কিন্তু আজ আমরা খুব ফর্মাল আচরণ করতে লাগলাম। কেউই নিজ থেকে কোনো খাবার বাছাই করলাম না, এবং শেষমেশ ওয়েটারের পরামর্শেই চারটা আইটেম অর্ডার করলাম: মৌরির ডাল, ঠাÐা মাংস, টফু ভাজা, আর নোনতা মাছ।
এক হাতে সিগারেট ও আর হাতে মদের পেয়ালা নিয়ে একটা তেতো হাসি হেসে সে বলল, ‘অনেকদিন পর ফের এখানে এসে নিজেকে খুব বোকা মনে হলো। ছোটবেলায় দেখেছিলাম, মৌমাছি কিংবা মাছি কি করে ঘুরেফিরে সেই একই জায়গায় এসে জড়ো হয়। ভয় পেলে তারা উড়ে যায়, কিন্তু একটা ছোট বৃত্তে কিছুক্ষণ ঘুরেফিরেই তারা হয়ত আবার আগের জায়গায় থিতু হওয়ার জন্য ফিরে আসে। তাদের এই ফিরে আসাকে আমার সত্যিই খুব বোকামিসুলভ এবং কষ্টদায়ক মনে হতো। কিন্তু আমি কখনো ভাবি নাই একটা ছোট বৃত্তে ঘুরপাক খেয়ে আমি নিজেও এরকম একই জায়গায় ফিরে আসবো। তোমার ক্ষেত্রেও আমি কখনো এমনটা ভাবি নাই। তুমি কি বৃত্তের বাইরে গিয়ে আরেকটু বেশি উড়তে পেরেছিলে?’
আমিও তেতো হাসি দিয়ে বললাম, ‘এটা বলা একটু কঠিন। সম্ভবত আমিও একই ক্ষুদ্র বৃত্তেই উড়ে বেরিয়েছি। কিন্তু তুমি কেন এতদিন পর আবার এখানে আসলে?’
‘একদমই অর্থহীন কিছুর প্রয়োজনে।’ কথাটি বলেই এক ঢোঁকে পেয়ালার সবটুকু মদ সাবাড় করে সিগারেটটায় কয়েক টান দিল সে। তারপর চোখ দুটো আরো খানিকটা টানাটানা করে নিল। বললো, ‘অর্থহীন হলেও তুমি হয়ত আগেও আমার কাছ থেকে এ ব্যাপারে শুনে থাকবে।’
মাত্র গরম করা মদ ও খাবার এনে টেবিলে রাখলো ওয়েটার। ফ্রায়েড টফুর ধোঁয়া আর সুবাসে উপরতলার কক্ষটা যেন মৌ মৌ করছে। এদিকে বাইরে এখন আরো ঘন তুষারপাত হচ্ছে।
সে আবার বলতে শুরু করল, ‘তোমার সম্ভবত মনে আছে, আমার একটা ছোট ভাই তিন বছর বয়সে মারা গেছে, এবং তাকে এখানটায় সমাহিত করা হয়েছে। আমি নিজেই আসলে মনে করতে পারছি না সে দেখতে কেমন ছিল। কিন্তু আমার মাকে বলতে শুনেছি, সে খুবই মায়াবি এক শিশু ছিল এবং আমাকে সে বড়ই পছন্দ পছন্দ করত। তার কথা বলতে গিয়ে এখনো আমার মায়ের চোখে পানি আসে। এই বসন্তে আমাদের এক কাজিন চিঠি দিয়ে জানালেন, আমার ভাইয়ের কবরের আশপাশের মাটি ধীরে ধীরে নদীতে ভেসে যাচ্ছে, শীঘ্রই কবরটাও ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের শীঘ্রই সেখানটায় যাওয়া উচিত এবং এ ব্যাপারে কিছু একটা করা উচিত। এ খবর শোনার পর আমার মা খুব ভেঙ্গে পড়লেন, কয়েক রাত ঘুমাতে পারলেন না। তুমি তো জানো তিনি নিজেই চিঠি পড়তে পারেন। কিন্তু আমি কি করবো? আমার হাতে টাকা নেই, সময় নেই। আমার আসলে করার মতো কিছুই নেই।’
‘নতুন বছরের ছুটি পাওয়ায় তার কবরটা অন্যত্র সরানোর জন্য আমার দক্ষিণে আসার সুযোগ হলো।’ বলেই সে আরেক পেয়ালা মদ পিয়ে নিল। তারপর জানালার দিকে তাকিয়ে বিস্ময় নিয়ে বলল, তুমি কি উত্তরে কখনো এমনটা দেখেছ? জমাট তুষারাবৃত ফুল, অথচ ভূতল বরফমুক্ত! যাই হোক, গত পরশুদিন একটা ছোট কফিন কিনলাম, কারণ আমার অনুমান ছিল, মাটির নিচের কফিনটা নিশ্চয়ই বহু আগেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। তাছাড়া কিছু তুলা ও বিছানাপত্র নিলাম, চারজন মজুর ভাড়া করলাম, কবর সরাতে এখানকার কর্তৃপক্ষের সাথেও আলাপ-আলোচনা করে নিলাম। এ কাজগুলো করতে গিয়ে আমি হঠাৎ খুব আনন্দ বোধ করতে লাগলাম। কবর খুঁড়তে এবং যে ছোট ভাইটি আমায় খুব পছন্দ করতো তার মৃতদেহ দেখতে আমি খুবই উদগ্রীব হয়ে পড়লাম। এ ছিল আমার জন্য সম্পূর্ণ নতুন এক অনুভূতি। কবরে পৌঁছানোর পর দেখলাম ঠিক ঠিকই নদীটা প্রায় কবর ছুঁই ছুঁই, বড়জোর দুই ফুট দূরে। ভাঙ্গাচুরা কবরটায় দুই বছর ধরে কোনো মাটি দেয়া হয়নি। যার ফলে এটি প্রায় হারিয়ে যাওয়ার দশায়। বরফে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত হয়ে কবরটার দিকে আঙ্গুল তাক করে শ্রমিকদের বললাম, ‘খোঁড়া শুরু করো’।
‘আমি আসলেই একজন সাধারণ গোছের লোক। নিজের এমন গলার আওয়াজ নিজের কাছেই অস্বাভাবিক মনে হলো। এবং জীবনে আমি যত আদেশ-নির্দেশ প্রদান করেছি এটিই ছিল তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। কিন্তু আমার এহেন আদেশে শ্রমিকরা একটুও বিচলিত হলো না, তারা স্বাভাবিকভাবেই কবর খোঁড়ার কাজে লেগে গেল। খোঁড়াখুড়ি প্রায় শেষ হতেই উঁকি দিয়ে দেখি, কফিনের কাঠগুলো সব একেবারে ক্ষয়ে গেছে, শুধু রয়ে গেছে একগাদা স্পিøন্টার আর কাঠের ছোট ছোট টুকরা। আমার হৎস্পন্দন বেড়ে গেল। নিজেই সাবধানে সবকিছু একপাশে সরিয়ে ছোট ভাইটিকে দেখতে চাইলাম। কিন্তু যা দেখলাম তার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। বিছানাপত্র, কাপড়চোপর, হাঁড়গোড়, সবকিছু উধাও! আমারও ধারণা ছিল, এতদিনে সবকিছু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে মাটির সাথে মিশে গেছে। কিন্তু আমি সবসময় শুনে এসেছি, চুল সহজে মাটির সাথে মিশে না। ভেবেছিলাম, আর কিছু পাওয়া না গেলেও কিছু চুল হয়ত এখনো পাওয়া যাবে। কবরের যে জায়গাটায় বালিশ থাকার কথা ছিল কুজো হয়ে সে জায়গার মাটিগুলো দেখলাম। কিন্তু ওখানেও কিছুই পেলাম না। কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট রইল না।’
হঠাৎ খেয়াল করলাম উই-ফুর চোখ লাল হয়ে গেছে। তবে বুঝতে পারলাম এটা মদ্যপানের প্রভাব। সে কদাচিৎ খাবার স্পর্শ করছে, অবিরত মদ গিলছে। এরই মধ্যে সে এক ক্যাটির বেশি মদ খেয়ে ফেলেছে এবং তার চাহনি ও অঙ্গভঙ্গি আরো ক্ষিপ্র হয়ে উঠেছে। বহুদিন আগে আমি যে লু উই-ফুকে চিনতাম ধীরে ধীরে সে তার মতো হয়ে উঠছে। ওয়েটারকে ডেকে আরো দুই ক্যাটি মদ গরম করতে বললাম। বলেই ঘাঁড় ঘুরিয়ে মদের পেয়ালা হাতে নিলাম, তার মুখোমুখি হলাম, সে যা বলতে চায় নীরবে তা শুনতে লাগলাম।
‘আসলে এরপর আর বেশি একটা আগানোর একদমই প্রয়োজন ছিল না। আমি শুধু কবরটা ভরাট করে কফিনটা বিক্রি করে দিলেই পারতাম। ঘটনাটা এখানেই শেষ হতে পারতো। যদিও কফিন বিক্রি করতে যাওয়াটা একটু ঝামেলার বিষয় ছিল, তারপরও যে দোকান থেকে কিনেছিলাম সেখানেই এটা বিক্রি করা যেত। কেনা দামের চেয়ে কম দাম পাওয়া গেলেও অন্তত মদ খাওয়ার জন্য কিছু টাকা রক্ষা করতে পারতাম। কিন্তু আমি তা করি নাই। তার মৃতদেহটা যেখানে শায়িত ছিল সেখান থেকে কিছু মাটি হাতে তুলে নিলাম। তারপর বিছানাপত্র সাজিয়ে তুলার উপর কিছু মাটি রাখলাম, তারপর মাটিগুলো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলাম। নতুন কফিনে পুরে আমার বাবাকে যেখানে সমাহিত করা হয়েছিল সেখানে গেলাম, এবং কফিনে মোড়ানো মাটির দলাকে বাবার পাশে সমাহিত করলাম। গতকাল ইট দিয়ে কবরের চারপাশটা ঘিরে দিলাম। এ নিয়েই গতকাল প্রায় সারাদিন ব্যস্ততায় কেটেছে। যেভাবেই হোক কাজটার একটা সুরাহা করতে পারলাম। অন্তত মায়েরে ফাঁকি দেয়ার জন্য এবং তার আত্মার শান্তির জন্য এটুকু আমার করা লাগলো।’
‘তুমি আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছো! তুমি কি এতটা বদলে যাওয়ার জন্য মনে মনে আমাকে গালমন্দ করছ? হ্যাঁ আমার এখনো সেই সময়ের কথা মনে আছে, যখন টুটেলারি মন্দিরে গিয়ে আমরা মূর্তিগুলোর দাড়িগোঁফ উপড়ে ফেলতাম। মনে আছে, সশরীরে লড়াইয়ে নামার আগে কি করে সারাদিন চীনকে বিপ্লবী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার উপায় নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম। কিন্তু এখন আমি এমনই। যা যেভাবে চলছে তাকে সেভাবেই চলতে দিতে এবং সবকিছুর সাথে আপস করে চলারই পক্ষপাতী। মাঝে মাঝে আমি ভাবি, আমার পুরানা বন্ধুরা আমাকে এখন দেখলে সম্ভবত আর বন্ধু হিসেবে স্বীকার করবে না। কিন্তু যেমন দেখছো এটাই এখন আমি।’
সে আরেকটা সিগারেট হাতে নিল, মুখে নিয়ে সিগারেটটা জ্বালাল।
তারপর বলল, ‘তোমার চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমার ব্যাপারে এখনো তোমার আশা আছে। প্রকৃতির নিয়মেই আমি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছি। তারপরও কিছু বিষয় আমি এখনো অনুভব করতে পারি। যার কারণে তোমাদের প্রতি এখনো আমি কৃতজ্ঞতা অনুভব করি। একইসঙ্গে বিব্রতও বোধ করি। আমার ভয় হয়, আমার পুরনো বন্ধুদের মধ্যে যাদের এখনো আমার ব্যাপারে ক্ষীণ আশা রয়েছে তাদেরকে আমি কেবলই নিরাশ করে চলছি কিনা।’ সে থামলো এবং আবার শুরু করার আগে সিগারেটটায় একসাথে কয়েক টান দিয়ে নিল। তারপর ধীরে ধীরে বলতে লাগল: ‘আজকেও, এখানে আসার আগেই, আমি একটা বৃথাকাজ করে এলাম। এবং এই কাজটি করতে গিয়ে আমি বেশ আনন্দই পাচ্ছিলাম। পুবের দিকটায় থাকার সময় চ্যাং ফু নামে আমার এক পড়শি ছিল। পেশায় সে ছিল একজন মাঝি। আহ শুন নামে তার এক কন্যা ছিল। আমার এই বাড়িটায় সেই সময় তুমিও এসেছিলে। মেয়েটাকে তোমার চোখে পড়ার কথা। কিন্তু তুমি হয়ত মেয়েটাকে খেয়াল করো নাই। কারণ সে তখন খুব ছোট ছিল। বড় হওয়ার পর সে দেখতে খুব একটা সুন্দর হয় নাই। তার মুখটা ছিল শাদামাটা, শুকনা ও গোলগাল আর ত্বক ছিল পাÐুর। তার চোখজোড়া ছিল অস্বাভাবিকরকম বড়, পাপড়িগুলো লম্বা লম্বা এবং চোখের শাদা অংশটুকু ছিল রাতের মেঘহীন আকাশের মতো স্বচ্ছ। এখানকার আকাশ নয়, আমি উত্তরের মেঘহীন আকাশের কথা বলছি, যখন বাতাস একদমই থাকে না। এখানকার আকাশ খুব একটা স্বচ্ছ নয়।
মেয়েটা ছিল বেশ শক্তসামর্থ্য। কৈশোরেই সে তার মাকে হারিয়েছে। ছোট এক ভাই ও এক বোনের দেখাশোনা তারই করতে হতো। এছাড়া পিতার দেখভালও তাকেই করতে হতো। এই সবকিছুই সে খুবই দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করত। বেশ হিসাবীও ছিল সে, যার কারণে পরিবারে ক্রমশ সমৃদ্ধি আসতে লাগল। তার প্রশংসা করত না এমন পাড়াপ্রতিবেশি খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর। এমন কি চ্যাং ফু নিজেও প্রায় সময় তার মেয়ের প্রশংসা করত।
এইবার যখন সফরে বের হলাম তখন মা আমাকে এই মেয়েটার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। পুরানা লোকদের স্মরণশক্তি বেশ প্রখর। স্মৃতি হাতরিয়ে মা জানালেন, একবার আহ শুন একজনকে চুলে নকল লাল ফুলের মালা পরতে দেখেছিল। দেখে তারও খুব পরতে মন চাইল। পিতার কাছে সে আবদার করল, তিনি যেন তাকে এমন একটা মালা এনে দেন। কিন্তু পিতা মালা না নিয়েই বাড়ি আসলো। ফুলের মালা না পেয়ে সে প্রায় সারারাত কান্নাকাটি করলো। এমন অযৌক্তিক আবদার ও রাতভর কান্নাকাটি করায় তার পিতা তাকে মারধর করলো। দুই কি তিন দিনের মতো তার চোখ লাল হয়ে ফুঁলে ছিল। এই ফুলের মালাগুলো পাওয়া যেত অন্য প্রদেশে, ‘শÑ’তে এগুলো কিনতে পাওয়া যেত না। সুতরাং বাবার কাছে এরকম আবদার করাটাই ছিল বোকামি। আমি যেহেতু এইবার দক্ষিণের দিকে আসছিলাম, তাই মা বললেন, মেয়েটার জন্য যেন দুইটা নকল ফুলের মালা কিনে নিয়ে যাই।
এই দায়িত্ব পেয়ে আমি বিরক্ত হওয়ার পরিবর্তে বরং খুশিই হলাম। আহ শুনের জন্য কিছু করতে পারব এটা ভেবে আমার আনন্দই হলো। গত বছরের আগের বছর আমি যখন মাকে আনতে গিয়েছিলাম তখন একদিন চ্যাং ফুর সাথে আলাপ হলো। চ্যাং ফু তার বাড়িতে একবাটি বাজরার জাউ খাওয়ার জন্য আমাকে দাওয়াত করতে চাইলেন। জানালেন, জাউয়ে তারা সাদা চিনি ব্যবহার করে থাকেন। বলা ভালো, একজন মাঝির বাড়িতে সাদা চিনি থাকার মানে হলো তিনি নিশ্চয়ই গরিব না, এবং তিনি বেশ ভালো খাবারই খান।
আমি রাজি হলাম এবং দাওয়াত গ্রহণ করলাম। তবে তাকে বিনয়ের সাথে জানালাম, আমাকে যেন ছোট এক বাটি জাউ খেতে দেয়া হয়। তিনি আমার আরজ বুঝতে পারলেন এবং আমি যখন দাওয়াত খাওয়ার জন্য তার বাড়িতে গেলাম তিনি তখন আহ শুনকে বললেন, ‘এই পÐিত সাহেবদের কোনো খিদে নেই। তুমি ছোট বাটিতে দিতে পারো, তবে চিনি কিন্তু বাড়িয়ে দিবে!’ যাই হোক, সে যখন খাবারটা বানিয়ে নিয়ে এলো তখন আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কারণ সে সেই বাটিটা ছিল বিশাল। এত খাবার সারাদিনেও আমি খাই না। কিন্তু এইটা সত্য, চ্যাং ফুর বাটির তুলনায় আমার বাটিটা দেখতে ছোটই ছিল। জীবনে কোনোদিন আমি বাজরার জাউ খাই নাই। এই প্রথম এই খাবার পরখ করলাম। সত্যি বলতে, প্রচÐ মিষ্টি হওয়া সত্তে¡ও ওটা ছিল খাওয়ার অযোগ্য। অনেকটা অন্যমনস্কভাবেই কয়েকবার জাউ মুখে পুরলাম, এবং আর না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের থেকে একটু দূরে, ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে আহ শুন। তাঁর চোখে চোখ পড়ার পর আমি আর চপস্টিক দুইটাকে হাত থেকে নামিয়ে রাখতে পারলাম না। তার চোখেমুখে আমি ভয় ও আশা দুইই দেখলাম। ভয় পাচ্ছে, কারণ, তার মনে হচ্ছে খাবারটা নিশ্চয়ই ভালো হয়নি। অন্যদিকে, আমাদের হয়ত খাবারটা ভালোই লাগছে এই ভেবে সে ভরসা পাচ্ছে। আমি জানি, আমি যদি আমার খাবারের বেশিরভাগটাই না খেয়ে ফেলে রাখি তাহলে সে আশাহত হবে এবং এর জন্য নিজের ভুলকেই দায়ী করবে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আমি মনে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে নিলাম, এবং বড় করে হা করে একেবারে চ্যাং ফুর মতই দ্রæতগতিতে মুখে খাবার পুরতে শুরু করলাম। কাউকে জোর করে খাওয়ালে তার কি দশা হয় আমি সেবারই তা পুরোপুরি অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। খাওয়ার সময় আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ল। ছোটবেলায় পেটের কৃমি তাড়াতে লাল চিনির সাথে ঔষধ মিশিয়ে যখন খেতে দিত তখন আমি ঠিক এরকম জটিল একটা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতাম। খাবার শেষে যখন সে খালি বাটিগুলো নিতে আসলো তার মুখে তখন একটা অর্ধস্ফ‚ট সন্তুষ্টির হাসি দেখতে পেলাম। তার সেই হাসি দেখে আমার সকল বিরক্তি মুহূর্তেই উবে গেল। আমার অস্বস্তিকে ছাপিয়ে গেল তার সেই তৃপ্তির হাসি। সেই রাতে বদহজমের কারণে আমার ভালো ঘুম হয় নাই এবং সারারাত দুঃস্বপ্ন আমাকে তাড়িত করেছে। তারপরও, আমি মন থেকে কামনা করেছিলাম আহ শুন যেন জীবনে সুখী হয়। আশা করেছিলাম, অন্তত তার ভালোর জন্য হলেও দুনিয়ায় একদিন পরিবর্তন আসবে। হা হা। সেই সময় আমি কেমন ভাবালুতায় ভুগতাম এইসব তারই প্রমাণ। কিছুদিন পরই অবশ্য নিজের এইসব ভাবনার কথা ভেবে নিজেরই হাসি পেতে লাগল। দ্রæতই তাদের ভুলে গেলাম।
‘আমি অবশ্য আগে জানতাম না যে একটা নকল ফুলের মালার জন্য তাকে মার খেতে হয়েছে। মায়ের কাছ থেকে যখন এই ঘটনা শুনলাম তখন আমার জাউ খাওয়ার ঘটনাটাও মনে পড়লো এবং অকারণেই তার জন্য নকল ফুল কেনার ব্যাপারে আমার মধ্যে একটা তৎপরতা শুরু হলো। এই ফুলের জন্য আমি প্রথমে গেলাম তাইওয়ান, কিন্তু সেখানকার কোনো দোকানে পেলাম না। সিনানে গিয়েই কেবল …’
জানালার বাইরের ক্যামেলিয়া গাছটা থেকে হুড়মুড় করে এক খÐ তুষার ঝরে পড়ল। তুষারের ভারে গাছের ডালগুলো চাপা পড়ে ছিল। এখন ডালগুলো আগের মতো সোজা হতে পারলো। তাদের গাঢ় সবুজ পাতা আর রক্তলাল ফুলগুলো এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আকাশের রং আগের চেয়ে ধূসর। সন্ধ্যা ঘনিয়েছে, তাই সম্ভবত চড়–ই পাখিদের কিচিরমিচির বেড়ে গেছে। সবকিছু তুষারে ঢাকা পড়ায় এখন আর তাদের খাবার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। হয়ত তাই দ্রæত বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার কথা ভাবছে।
উই-ফু কিছুক্ষণ জানালার দিকে তাকিয়ে রইল। জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে সে এক পেয়ালা মদ গিলল, আর সিগারেটে কয়েকটা টান দিল এবং আবার বলতে শুরু করল, ‘সিনানে গিয়েই কেবল নকল ফুলের মালা কিনতে পারলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম না ঠিক এই মালার জন্যই তাকে মার খেতে হয়েছিল কিনা। তবে মায়ের বর্ণণার সাথে আমার কেনা মালার অন্তত একটা মিল ছিল: ফুলগুলো ছিল মখমলের। আমি ঠিক জানতাম না তার হালকা রং পছন্দ নাকি গাঢ় রং। ফলে দুই ধরনের মালাই কিনলাম; একটা লাল, আরেকটা গোলাপী।’
‘চ্যাং ফুর সাথে দেখা করব বলেই একদিন বেশি থাকলাম। দুপুরের খাওয়া সেরে বিকেলের দিকে রওনা হলাম চ্যাং ফুর বাড়ির উদ্দেশে। তার বাড়ি ঠিক আগের জায়গায়ই ছিল, খালি বাড়িটাকে দেখে একটু মরা মরা মনে হলো, এটা আমার কল্পনার কারণেও হতে পারে। তার ছেলে ও দ্বিতীয় কন্যা আহ চাওকে বাড়ির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। দুইজনই বড় হয়ে গেছে। আহ চাও ছিল তার বোনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। দেখতে খুব সাদাসিধেই ছিল সে। আমাকে তাদের বাড়ির দিকে আগাতে দেখে সে এক দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, চ্যাং ফু বাড়িতে নেই। তারপর প্রশ্ন করলাম, ‘তোমার বড়বোন কই?’ এই প্রশ্ন শুনেই সে আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল এবং জানতে চাইল কেন আমি তাকে খুঁজছি। মনে হলো সে প্রচÐ রেগে যাচ্ছে এবং এখনই আমার দিকে তেড়ে আসবে। আর কথা না বাড়িয়ে ইতস্তত করতে করতে হাঁটা দিলাম। ইদানিং আমি কোনোকিছু নিয়ে খুব বেশি ঘাঁটাই না …’
‘তুমি চিন্তাই করতে পারবে না ইদানিং আমি লোকজনের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করতে কি পরিমাণ ভয় পাই। আমার ভালোমতোই জানা হয়ে গেছে, সবখানেই আমি আসলে অনাহুত। এমনকি আমার নিজের কাছেও। কেন আমি অন্যের উপর অনধিকার চর্চা করতে যাব? কিন্তু চ্যাং ফুর বাড়ি থেকে কেন জানি সোজা ফিরে আসতে পারলাম না। এইবার আমার কেন জানি মনে হলো আমার অর্থহীন অনধিকার চর্চা করা উচিত। কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে ওদের বাড়ির ঠিক উল্টাদিকের কাঠের দোকানটায় গেলাম। ভাগ্য ভালো, দোকানদারের মা বেগম ফা ওখানে ছিলেন এবং আমাকে চিনতে পারলেন। তিনি আমাকে দোকানের ভিতরে এসে বসতে বললেন। ভদ্রতাসূচক বাক্য বিনিময়ের পর আমি তাকে ‘শ’তে আসার কারণ জানালাম এবং চ্যাং ফুর খোঁজ করলাম। তিনি যখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথা বলা শুরু করলেন আমি তখন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়লাম।’
বৃদ্ধা বললেন, ‘আহা! আপনি যে ফুলগুলো নিয়ে আসলেন সেগুলো পরার মতো ভাগ্য আহ শুনের নাই।’
তারপর তিনি পুরো ঘটনার বর্ণনা দিলেন: ‘সম্ভবত গত বসন্ত থেকে আহ শুনের চেহারা বিবর্ণ হইতে শুরু করল, তার শরীর শুকিয়ে যেতে শুরু করল। হঠাৎ হঠাৎ সে কেঁদে উঠত। কেউ কারণ জানতে চাইলে কিছু বলত না। মাঝে মাঝে সারারাত কান্না করত। চ্যাং ফু মেজাজ হারিয়ে তাকে গালাগালি শুরু করত; বলত, আইবুড়ী হয়ে এতদিন বসে থাকায় সে পাগল হয়ে গেছে। চ্যাং ফুর গালাগালির পর সে হয়ত কান্না থামাত। শরৎ আসার পর তার সামাণ্য ঠাÐা লাগে। কিছুদিন পরই সে শয্যাশায়ী হয়, এবং আর কখনো সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। মরার মাত্র কিছুদিন আগেই সে চ্যাং ফুকে জানায়, অনেক আগেই সে তার মায়ের রোগে আক্রান্ত হয়েছে। মায়ের মতো প্রায়ই তার রক্তবমি হতো, এবং রাতে তার শরীর ঘামতো। পিতা দুশ্চিন্তা করবে ভেবে এতদিন সে বিষয়টি গোপন রাখে। এই অসুস্থতার মধ্যেই এক সন্ধ্যায় তার চাচা চ্যাং কেং তার কাছে টাকা চাইতে আসে। সবসময়ই সে এরকম টাকা চাইতে আসত। যখনই আহ শুন টাকা দিতে পারতো না তখনই এক গাল হাসি দিয়ে দিয়ে বলতো, ‘এত চ্যাটাং চ্যাটাং করিস না; তোমার নাং কিন্তু আমার চাইতে খারাপ লোক!’ প্রায়ই সে আহ শুনকে এরকম কথা শোনাত। তার এই কথা আহ শুনকে বড়ই পীড়িত করত। কিন্তু সে এতটাই লাজুক ছিল যে পাল্টা কোনো প্রশ্ন করত না, শুধুই কাঁদত। চ্যাং ফু যখন এই বিষয়ে জানতে জানতে পারলো তখন সে মেয়েকে জানাল যে তার হবু স্বামী খুবই ভদ্র ছেলে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাছাড়া বাপের কথা সে বিশ্বাসও করল না। বাপকে সে বললো, ‘ভালো হলো যে আমি এখন এই অবস্থায় আছি। এখন কোনো কিছুতেই আমার কিছু আসে যায় না।’
বৃদ্ধা বলে চললেন: ‘যদি তার প্রেমিক ছেলেটা আসলেই চ্যাং কেংয়ের চেয়ে খারাপ লোক হত তবে তা আসলেই একটা ভয়াবহ ব্যাপার হতো। চ্যাং কেং ছিল মুরগী চোর। এর চেয়ে খারাপ হওয়া মানে সত্যিই ভয়ংকর ব্যাপার। কিন্তু ছেলেটা যখন আহ শুনের অন্ত্যেষ্টিতে যোগ দিতে আসলো আমি তখন তাকে নিজ চোখে দেখেছি। তার কাপড়চোপড় ছিল বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সে ছিল খুবই সুদর্শন। ছল ছল চোখে ছেলেটা বলল, বিয়ে করার জন্য টাকা জমাতে এই কয় বছর সে নৌকায় কঠোর পরিশ্রম করেছে, কিন্তু এখন যাকে বিয়ে করবে সে-ই নেই। ছেলেটা নিঃসন্দেহে ভালো ছিল। চ্যাং কেং যা বলত তার সবই ছিল ডাহা মিথ্যা। হায় এই দুঃখ কই রাখি! মেয়েটা এই অসভ্য মিথ্যুক লোকটার কথাই বিশ্বাস করলো এবং অকারণেই মারা গেল। কিন্তু এখন আর কাউকে দোষ দেয়া সমীচীন হবে না। এটাই আহ শুনের নিয়তি।’
এই যেহেতু ঘটনা, সুতরাং আমার তো কিছু করার নাই। কিন্তু ফুলের মালা দুটির কি হবে? বুড়িকে বললাম, আপনি এই ফুলগুলো আহ শুনের বোন আহ চাওকে দিবেন। আহ চাও মেয়েটা আমাকে দেখেই এক দৌড়ে পালিয়ে গেছে; যেন আমি একটা নেকড়ে কিংবা দৈত্য। আমার খুব একটা ইচ্ছে হচ্ছিল না তাকে ফুলগুলো দেই। দিলাম অন্য একটা কারণে। বাড়ি ফিরে মাকে বলব, আহ শুন ফুল পেয়ে খুবই খুশি হয়েছে। এই তো। এইসব মামুলি ঘটনা নিয়ে এত মাথাব্যথার সময় কই? কোনো একভাবে একটা সমাধান করা আরকি। আমার কর্তব্য আমি পালন করেছি। নববর্ষের ছুটিটা পার করে আবার কনফুসীয় ক্লাসিক পড়াতে ফিরে যাব।
আমি একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, ‘তুমি কি এখন এইসব পড়াচ্ছ?’
‘হ্যাঁ অবশ্যই। তুমি কি ভাবছিলা আমি ইংরেজি পড়াই? প্রথমে আমার দুইজন ছাত্র ছিল। একজন পড়ত ‘শিচিং’, আরেকজন ‘মেনসিউস’। সম্প্রতি একজন নতুন ছাত্রী পেলাম, সে পড়ছে ‘রমনীক‚লের জীবনবিধান’। আমি এখন গনিতও পড়াই না। এমন না যে আমি ইচ্ছা করে পড়ানো বাদ দিয়েছি, তারাই পড়তে চায় না।’
‘আমি সত্যিই কখনো ভাবি নাই তুমি কোনোদিন এইসব বই পড়াবা।’
‘তাদের পিতারা চায় তারা এইসব বই পড়–ক। আমি এখানে আগন্তুক, সুতরাং আমার কাছে সবই সমান। তাছাড়া এইসব অনর্থক বিষয় নিয়ে এত মাথা ঘামানোর সময় কই? এইসবকে এত সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নাই।’
তার চেহারা টকটকে লাল হয়ে আছে, মনে হচ্ছে পুরোপুরি মাতাল। কিন্তু চোখ দুটি নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে। আমি হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কিছুক্ষণ বলার মতো কিছু পেলাম না। সিঁড়ি থেকে ঠক ঠক শব্দ আসছে। কয়েকজন কাস্টমার উপরে উঠে আসছে। প্রথমজন বেটে মতো, গোলগাল ফুলাফালা মুখ; দ্বিতীয়জন বেশ লম্বা, তার নাকটা চোখে পড়ার মতো লাল। তাদের পেছনে বাকিরা। তাদের উপরে উঠে আসার কারণে ছোট্ট উপরতলাটা কেঁপে উঠল। আমি লু উই-ফুর দিকে ফিরলাম, সেও আমার চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছে। আমি ওয়েটারকে ডেকে বিল দিতে বললাম।
উঠে যেতে যেতে তাকে প্রশ্ন করলাম: ‘যে বেতন পাও তাতে চলে তোমার?’
‘আমি মাসে বিশ ডলার পাই, চলার জন্য পুরোপুরি যথেষ্ট নয়।’
‘সামনে তাহলে কি করার কথা ভাবছো?’
‘সামনে? জানি না। আচ্ছা ভাবো তো আমরা অতীতে যা আশা করেছিলাম কিংবা পরিকল্পনা করেছিলাম তার একটাও কি পূরণ হয়েছে? আমি এখন কোনো কিছুর ব্যাপারেই নিশ্চিত নই; আগামীকাল কি করব তাও জানি না, এমনকি এক মিনিট পর কি করব তাও না…’
ওয়েটার বিল এনে আমার হাতে দিল। উই-ফু আগের মতো ফর্মালিটি করার চেষ্টা করল না; শুধু এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুঁকতে থাকল এবং আমাকেই বিল দিতে দিল।
আমরা একসাথে বেরিয়ে আসলাম। এখান থেকে যেই দিকে আমার হোটেল তার বিপরীত দিকে তার হোটেল। সুতরাং দরজায় দাঁড়িয়েই আমরা একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। একা একা হোটেলের দিকে হাঁটছি; ঠাণ্ডা বাতাস ও তুষার এসে আমার মুখে বাড়ি খাচ্ছে, বেশ চাঙ্গা অনুভ‚ত হচ্ছে। আকাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। ভাসতে থাকা শাদা জমাটাবাঁধা তুষারগুলো যেন সুতা হয়ে আকাশ, ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাটগুলোকে একই মালায় গেঁথে রেখেছে।