দূরবীনঃ পাঠ প্রতিক্রিয়া

আব্দুল মতিন

১৯২৯ সালের শীতকালের এক ভোরে হেমকান্ত চৌধুরীর হাত থেকে কুয়োর বালতি পড়ে যায়। হেমকান্ত চৌধুরী নির্বিরোধী জমিদার। আত্মমগ্ন। চুপচাপ স্বভাবের। ডায়েরি রাখেন। এক আশৈশব বন্ধু সচ্চিদানন্দের কাছে লেখা চিঠিগুলোও এক অর্থে ব্যক্তিগত ডায়েরিই। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বৃহৎ কলেবরের এই উপন্যাসও এক ঝটকায় শুরু হয় গল্পের মতন। ৬১৬ পৃষ্ঠা আর ১০৬ অধ্যায়ের উপন্যাসটিকে কলেবরে বৃহৎ বলাই সঙ্গত। তবে কাহিনীর কাল কাঠামো নির্মাণ করেছেন অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে।  

ঔপন্যাসিক কাহিনী নির্মাণে অসম্ভব কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন বৈকি। তিনপুরুষের জীবনগল্পকে তিনি ছেঁটে এনেছেন প্রায় এক যুগে। অর্ধযুগ তিনি নিষ্ঠার সাথে বরাদ্দ করেছেন হেমকান্ত চৌধুরী এবং তার পরিবারের জন্য। বাকিটা সময় হেমকান্তের পুত্র কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী এবং নাতি ধ্রুব চৌধুরীর। পিতা পুত্রের ভালবাসা, তাদের মধ্যকার প্রজন্মগত ব্যবধান-প্রসূত দ্বন্দ্ব ও তাদের উদ্বেল – উৎকণ্ঠা মাখা সম্পর্কের গল্প হলো দূরবীন। শুধু এটুকু হলেও দূরবীন উপন্যাস হিসেবে শিল্পোত্তীর্ণ হতো নিঃসন্দেহে। কিন্তু ঔপন্যাসিক কাহিনীকে নিয়ে ইচ্ছেমতো খেলেছেন। খুব সংকটময় মুহূর্তকে প্রয়োজনে টেনে প্রসারিত করেছেন – সুদীর্ঘ। কখনো সময়কে চেঁছে নিয়েছেন সুনিপুণ। সংলাপে এনেছেন রস। সংলাপে সংলাপে মানব মনকে করেছেন বিশ্লেষণ। দূরবীক্ষণে। দূরবীন নামকরণটি সে অর্থেও সার্থক রূপ লাভ করেছে। 

পরপর দুটি অধ্যায় সমান্তরাল বয়ে নিয়ে চলেছে দুটি ভিন্ন প্রজন্মকে। দুটি আলাদা সময়ের এতো সাবলীল প্রবহমানতা খুব একটা দেখা যায় না। উপন্যাসে প্লট দুটি। অসংখ্য সাবপ্লট। দুটি আলাদা দশককে লেখক পরপর গড়ে তুলেছেন এবং তাতে ঘটনার পরম্পরা কার্যত কখনোই বিঘ্নিত হয়না। 

লেখক হিসেবে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সুপ্রতিষ্ঠিত। ঔপন্যাসিক হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এসবের পশ্চাতে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভাষা-গভীরতার অবদান বোধহয় সবথেকে বেশি। তিনি জীবনকে দেখেছেন দার্শনিক চোখে। খুব নিকট থেকে। তাঁর জীবন-ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ মেলে উপন্যাসের পরতে পরতে। 

উপন্যাসের চরিত্রগুলো খুব বিচিত্র। হেমকান্ত চৌধুরী যেমন কিছুটা ভাব-গভীর, ঠিক কুঁড়ে প্রকৃতির হয়তো বলা সঙ্গত হবে না – তবে জীবন-ভাবনায় অহোরাত্রি নিমজ্জিত থাকতে ভালবাসেন। ছেলে কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী কিন্তু একেবারে বিপরীত। এককালের স্বদেশী আন্দোলন করা চরিত্রকে লেখক উপন্যাসের সবথেকে রহস্যময় পুরুষ হিসেবে আবির্ভূত করেছেন। রহস্যময়তার কিছুটা গোপন রঙ ছিটিয়েছেন রঙ্গময়ী চরিত্রেও। স্বদেশী মনোভাবাপন্ন রঙ্গময়ী, হেমকান্ত, কৃষ্ণকান্ত সবাই খুব সন্তান বৎসল। অফুরান পুত্রস্নেহ ছাড়া কৃষ্ণকান্ত আর হেমকান্তের ভেতরে মিল কিছু নেই। উপন্যাসান্তে সেটা বেশ স্পষ্ট। 

রেমি যেমন একটা সাধারণ বাঙালি রমণী – বিশাখাও তেমনি। এমনকি নোটনের মতো অত্যন্ত অপ্রধান চরিত্রেও রমণীয় কমনীয়তা লেপনে লেখক খুব কুশলী পরিচয় দিয়েছেন। 

দূরবীন উপন্যাসটা সংলাপ বহুল। কিছুটা অংশ ব্রহ্মপুত্রের আশেপাশের ময়মনসিংহ এলাকা, বাকিটা কলকাতায়। সংলাপ রচনায় দুটো ভিন্ন আঞ্চলিকতাকে লেখক অভিন্ন নজরে দেখলেও সেটা খুব স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে না – লেখকের ভাষা-সৌকর্যে। প্রতিটি চরিত্রের, বিশেষত হেমকান্ত চৌধুরী, ধ্রুব এবং রেমির গোপন মনের কথা লেখক প্রশংসনীয় দক্ষতায় রুপায়ন করেছেন। একি সঙ্গে তিনটি ভিন্ন চরিত্রের বিচিত্র চিন্তাভাবনার এমন সৌম্য প্রদর্শন খুব একটা চোখে পড়ে না। মনে হয় যেন খুব গভীরভাবে তিনি খেয়াল করেছেন আশেপাশের জীবন – প্রতিটা ঘটনায় মনোযোগের সাথে পলকহীন দৃষ্টি রেখেছেন – সর্বদা। বইয়ের ভেতরের চরিত্রগুলো এক সময় রক্তমাংসে জীবন্ত  আকার লাভ করে। পাঠকের সাথে – তার প্রতিটা দৈনন্দিন কাজে তারা যেন সঙ্গ দেয়। 

কাহিনী এমন আহামরি কিছু নয়। টান টান উত্তেজনা নেই। প্লটে কোথাও ক্লাইম্যাক্স খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবুও পাঠক একটা অমোঘ টান অনুভব করবেন পরের অংশটুকু পড়ে নেবার জন্য। 

আমি সাধারণত একটানা একটা বই পড়ে ফেলি। খুব পছন্দের উপন্যাসের বেলায় সময় নিয়ে কিছুটা পক্ষপাতিত্ব নিজের অজানায় করে ফেলি। দূরবীন পড়তে আমার প্রায় এক মাস লেগে যায়। ইচ্ছেকৃত বিলম্ব। এই পুরো সময়টায় আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। 

আমার মনে হয় দূরবীন সময় নিয়ে পড়বার বই। দূরবীনের কাঠামো-কৌশল স্বকীয় , স্থাপত্য স্বপ্রকাশ, সংলাপ রসময়, চরিত্র স্নিগ্ধ অথচ কী বিচিত্র তাদের পরিস্ফুটন এবং সর্বোপরি এর ভাষা সাবলীল, স্বতঃস্ফূর্ত। সংলাপের অপূর্বতায় পাঠক-মন, ইন্দ্রিয় সহসা চঞ্চল হয় – কখনো অজ্ঞাতসারে। কখনো পূর্ণ মনোযোগে পরিলক্ষ্য করে ধ্রুব-কৃষ্ণকান্তের দ্বন্দ্ব, ধ্রুব’র এন্টি-এস্টাবলিশমেন্ট চেতনা বা আপাত-বৈরাগ্যবিলাসী আচরণ, হেমকান্তের ভাব-প্রবণতা, রেমির প্রলাপ বা স্বপ্ন বা পরাবাস্তব জগতে বিচরণ। চুরাশি পঁচাশি সালের লেখা একটা উপন্যাসে স্বপ্ন – বাস্তবতার এমন সুনিপুণ মিশ্রণ সহজে লক্ষ্যগোচর হয়না। 

দূরবীন তাই শিল্পোত্তীর্ণ। পাঠক সানন্দচিত্তে উপন্যাসটিকে কালোত্তীর্ণ করবেন – এই আমার অবিচল বিশ্বাস।

লেখকঃ আব্দুল মতিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।