তুমি হাটলে যা যা হয়
অনেকদিন পর তখন সূর্য উঠছে–
তুমি হেঁটে আসছো–
সারা রাস্তা ভাসিয়ে একটি তুখোড় জলোচ্ছ্বাস
তার সমুদ্রস্পর্ধাকে যত্নে বয়ে আনে,
এখানেই পৃথিবী শেষ হয়,
আমি চেয়ে দেখি সারা বিকেল গ্রাস হয়ে আছে–
যেন সকল বিষাদ, মৃত্যুযন্ত্রণা
পথের দু’পাশ থেকে মাত্র সরে গেলো,
যেন বহুদিন শুভকিছু ঘটেনি পুরুষের সাথে,
যেন এমন সুস্থতা এর আগে জানেনি মানুষ।
তুমি একবার আসছো এখনো,
বারবার আমার পায়ের নীচের মাটি
অসংখ্য দোলনা হয়ে উড়ে যায়,
আমার প্রতিটি উৎসবের জন্য বরাদ্দ সবকটি বাজি
আপনা-আপনি ফেটে যাচ্ছে বুকের নিনাদে,
আমি সম্বিত পেয়েছি-
এইতো এইতো!
একে আমি পাই কি পাই না, আমি পাই আমার জীবন-চৈতন্য,
আর কোনো প্রশ্ন নেই, এতকাল কী করেছি আমি– সমস্ত পাপ;
বোধহীন, চৈতন্যহীন কাটিয়েছি আমি;
ঈশ্বরকে কি আমি ক্ষমা করব–
এই দৃশ্য দুনিয়ায় কেন আগে হলো না!
আমার ভাবনা হচ্ছে এতদিন ধরে আমার তিলতিল
সঞ্চিত জ্ঞান– ব্যবিলনের প্রতিরক্ষা, কামাখ্যা মন্দির,
বোধির সন্যাস, মসজিদের বয়ান, শীতের মাহফিল,
শ্রেষ্ঠ উপদেশমালা, কঠিন নিষেধাজ্ঞা,
আমার এতদিন পান করা বেদুইন জ্যামিতি–
ওরা কি আমায় ক্ষমা করবে?
যে প্রবীণ দুই চোখ এই পৃথিবীর ঢঙ, তরঙ্গ দেখে
ঝাপসা হয়েছে প্রায়,
ওরা আজ চাঁদ অস্বীকার করে বসে আছে
একটি মুখের উদয়ে,
ওরা দেখে– তারাগুলো উড়ে যায় চুলের উড়নিতে!
সূর্য উঠছে,
আমি থির তাকিয়ে আছি,
তুমি চিরদিন আসতে থেকো এই সামান্য দূরত্ব থেকে,
আমি অপলক দেখব কী কী হয় তোমার আসায়-
অনেকগুলো চোখ বয়ে নিয়ে, অনেক ঈর্ষা ছড়াতে ছড়াতে
তুমি হেঁটে হেঁটে ছিটকে আসছো সমুদ্রভঙ্গিমায়,
আমার সমস্ত বার্ধক্যের দিকে।
~~~
জোছনা এই ই—
আবার চাঁদ উঠবে,
বহু উপলক্ষ্যের দিকে ভেসে যাবে আবার পৃথিবী;
জোছনার নীচে বেড়াতে এসে শিকারি ও গজার
দু’জন দুজনকে দেখে বলবে
কী দারুণ!
উৎসুক না হলেও দ্বিধান্বিত হয়ে যেতে পারে
শরীরের, মনের জোয়ার—
এই চাঁদ, এই বরফ-আগুন বিরল বিরল না—
এই হৃদয় নিয়ত মুখর, নিয়ত উদাস।
পৃথিবীর উপলক্ষ্য হয়ে জোছনায় ভেসে যায়
পৃথিবীর উপগ্রহ,
মুখের সামনে গোলগাল, নীল-সাদা-হলুদ-কমলা,
পূর্ণ আলো-
একটি চাঁদ, চাঁদের অতূল্য মুখ;
পৃথিবীর গভীর নীলাকাশে গভীর গণ্ডগোলে
অথবা সমুদ্র থেকে উঠে আসা সবুজ কুয়াশায়
চাঁদ যে’রাতে ঝাঁপ দেবে সমুদ্রের বুকে—
স্কুবা-ডাইভিং—
অনন্তর উপলক্ষ্যে তখনও ছেয়ে আছে
আমার রুপালী পৃথিবী।
সেদিনও প্রাচীন উপায়ে
বা আরো প্রবল উৎসাহে পাখিদের ডাকছে পোকারা,
কুকুরদের মানুষ— ভ্রমণের দিকে;
কোথায় লেকের পাড়ে ছায়া নড়ে—
গাছের নীচে পাতার আসনে
নিরিবিলি শুয়ে যেখানে ভরপুর সঙ্গম করা যায়
চাঁদে না অন্য ফিজিক্স-আলোয়।
পালানোর নতুন জানালা
হাতের দক্ষিণে ধীরে-ধীরে খুলে আসে
নতুন উপায়ে— এত সাবলীল!
এই চাঁদ কোন অর্থে জাগেনি,
আমরা আজ পর্যন্ত কিছুই দেখিনি চাঁদের দিকে তাকিয়ে
আরেকটি সাধারণ উপলক্ষ্য ছাড়া।
যখন চাঁদ ফসফরাসের ডানা মেলে,
ডানাঅলা চাঁদকে আমরা বলেছি জোনাকি,
সবুজ ডাঁট ছেড়ে বাতাসে যে চাঁদ হালকা হয়ে উড়ে যায়,
আমরা তাকে ডাকি ছাতিম ও কাঁশফুল;
অথবা বৃষ্টি ও শীত— কেনোভাবেই যা চাঁদগোত্রীয় না—
আমরা সেগুলো ছুঁয়ে দেখেছি আরেকটি জোছনা ভেবে।
কাছে গেলে কিছু নিজের ভাণ্ডে আসে—
একদিন বাঁচার জন্য সুন্দর আবহাওয়া,
স্বপ্নের জন্য একঘুম,
কল্পনার জন্য ধ্যান,
একদিন নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্য দুর্দান্ত প্রদর্শণী।
পৃথিবীর কোনো আলাদা চাঁদ নেই।
আলোহীন চাঁদেও পৃথিবীর পূর্ণি হয়।
জোছনাহীন চাঁদ বা চাঁদহীন পৃথিবীতে
কোথায় যেন ময়ূরের কণ্ঠ শোনা যায়,
নলখাগড়ায় শুয়ে আছে খয়েরী শেয়ালের ঘুম;
এই সীমানায় একদিন যদি আর একটিও পাখি না ডাকে,
অন্যসীমানায় ছোট্ট লার্ভা ডানা খুলে।
বা এটুকুও আশা! শুধুই বিদ্যুৎ-যন্ত্রের জীব।
বা বিপদবেলা— যখন বর্ষা হয়ে অজস্র বেগুনী সুই
সূর্যের বুক থেকে রিমঝিম ঝরে পড়ে,
হাওয়ায় হাওয়ায় কাঁপে দিন রাত—
ওপাশে কিছুই নেই— নাকে গ্যসমাস্ক চেপে
সোনালী সূর্য,
রুপালী বর্ষাধারা
অপলক মনিতে মুগ্ধ দেখে যাওয়া…
জোছনা এই ই— এই ই উপলক্ষ্য—
সবখানে সারাটা ছড়িয়ে পড়েছে।
~~~
কবিঃ মেসবাহ কামাল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।