কারাগারের জেমস বাল্ডউইনঃ সার্বজনীন রাজনৈতিক লেখক

আবু জর গিফারি

জেমস বাল্ডউইন যখন টেরি ডিক্সনের সাথে ডকুমেন্টারি করতে রাজি হয়, সে হয়তো নিজেও জানতো না সে কিভাবে পোট্রে হবে টেরি ডিক্সনের চোখ দিয়ে। হয়তো জানতো না, হয়তো ভয় ছিল, ছিল চিরাচরিত সন্দেহ। হয়তো নাটকীয় কারসাজির শিকার হবে, না হয় শিকার হবে পরিকল্পিত নাটকীয় নকশার। তবে কিছু বিষয়ে বাল্ডউইন নিঃসন্দেহ ছিল, তার ব্ল্যাক এক্সপেরিয়েন্স যদি দুটি বিষয় জীবনে শিখিয়ে থাকে: কালোদের ভালোর জন্য কোনো পরিকল্পিত নকশা নেই; আর ওই সাদা চামড়াদের বিশ্বাস করা যাবে না। এই দুই বিশ্বাসের ফল হলো ২৭ মিনিটের পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে পাওয়ারফুল ডকুমেন্টারি৷

‘পাওয়ারফুল’ তকমাটা ডকুটি শুরু করার পর কারো কাছে বেমানান লাগলেও, তাকে কিছু আমেরিকান বর্ণবাদের জ্ঞান নিয়ে আসতে হবে৷ সাথে জানতে হবে বাল্ডউইন কে৷ আমি সাধারনত প্রয়োজনীয় পূর্বজ্ঞান দিয়ে শিল্প বুঝার ঘোরতর বিরোধী৷ যে আপনাকে এটা জানতে হবে শিল্পের সাথে পরিচয়ের আগে, না হয় আপনি শিল্পের মর্মার্থ বুঝতে পারবেন না। এটা জানলে শিল্পটি আপনার ভিতরে প্রবেশ করতে পারবে। এক্ষেত্রে আর্টিস্ট থেকে আর্টের ক্ষমতা, ঐ পূর্বজ্ঞান নির্ধারণ করে দেয়৷ যেনো শিল্পের চালিকাশক্তি থাকে না শিল্পী বা শিল্প নিজেই, মূল চালিকশক্তি হয়ে যায় ওই পূর্বজ্ঞান। কিন্তু ঠিক এই কারণেই বাল্ডউইন চায় – আপনি কিছু পূর্বজ্ঞান নিয়ে আসেন৷ পৃথিবীর কোনো আর্ট যদি একমাত্র সেই পূর্বজ্ঞান দাবি করার অধিকার রাখে তা হলো বর্ণবাদের ইতিহাস, বা আরেকভাবে বললে রক্ত মাংসের পরিপূর্ণ মানুষকে মানুষ না ভাবার ইতিহাস। সেই পূর্বজ্ঞান কে মনে করিয়ে দিতে টেরি ডিক্সনকে তিনি প্লেস ডি বাস্তিলে (যেখানে বাস্তিল দুর্গ ছিল) নিয়ে আসে৷ নিজেকেও এক কথায় পরিচয় করিয়ে দেয়– “সে পৃথিবীর কতিপয় কালো লোকেদের একজন, যার একটা ভয়েস আছে৷” সে অবগত তার প্রভাব সম্পর্কে৷ “সে চাইলে ববি সিল হতে পারতো, এঞ্জেলা ডেভিস হতে পারতো৷” কিন্ত শতাব্দীর এই টালমাটাল সময়ের মাঝে সে আমেরিকা থেকে চলে গিয়ে ফ্রান্সের অন্যতম প্রভাবশালী লেখক হলো৷ আর কালোদের জন্য হলো ‘দি’ পলিটিকাল রাইটার৷ 

জিমির সমুদ্র পাড়ি

১৯৪৮ এ বাল্ডউইন যখন হার্লেম— নিউইয়র্কের এই শহরেই বাল্ডউইনের জন্ম ও বেড়ে উঠা— ছেড়ে প্যারিসে আসে, ঠিক তার অল্পকিছু আগেই তার জীবনের টালমাটাল এক সময়ে সে হার্লেমের আরেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়। আমেরিকার কালোদের বৈষম্যের ইতিহাসকে আমেরিকার দক্ষিনাঞ্চল কেন্দ্র করে দেখানো হলেও, এখনো যেমন দেখা যায়, সে জাতিগত বৈষম্য এই তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’ প্রদেশগুলোতেও বিদ্যমান, জিমির (বাল্ডউইনের অন্তরঙ্গ নাম) সময়েও তার ব্যতিক্রম ছিল না। পদ্ধতিগত সে বর্ণবাদ যুবক বাল্ডউইনকেও দেখতে হয়েছে, যা আমেরিকার সমাজের শিরা উপশিরায় প্রোথিত ছিল। অনেকদিন যক্ষ্মায় ভুগে যখন তার বাবা ১৯৪৩ এ মারা যায়, তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন ছিল জিমির ১৯ তম জন্মদিন, আর হার্লেমের ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কের দিন। সেসময় ঘটা হার্লেম এর দাঙ্গা  নিয়ে সে তার ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনী  “নোটস অব এ নেটিভ সন” এ লিখেছে। এই দাঙ্গা তাকে তার দেশ সম্পর্কে জানিয়েছে, বুঝিয়েছে এই দেশ আদতে তাকে কতটা নিজের ভাবে। আর আদৌ সে এই দেশের বেঁধে দেয়া নিয়মমাফিক ‘সভ্য মানুষ’ কখনো হতে পারবে কি? জিমি আসলে সেই সাদাদের ‘সভ্য মানুষ’ হতে চায় না। তাই সে দাঙ্গার প্রভাবেই হোক, কিংবা না চাওয়ার তাড়না থেকেই হোক— তার দুটি আত্মপরিচয়: কালো ও সমকামী, যা তার দেশে নিরাপদ নয়, তা নিয়ে প্যারিসে পাড়ি জমায়।

তার এই দুটো সত্তার নিরাপত্তা নিয়ে সে এই ডকুমেন্টারিতেও বলেছে। সে যদি আমেরিকায় থেকে যেত, সে মারা পড়ত। যেভাবে তার কাছের বন্ধু মারা পড়েছে। দৈহিক খুন বা আত্মিক খুন। দ্বিতীয় রকমের খুনটার পরে সে আত্মহত্যার পথ নিতে বাধ্য হবে। যদিও এই স্বর্গের নিচের পৃথিবীতে জীবনের মূল্যই তার কাছে সবচেয়ে বেশি, সে তবুও সমাজের পদ্ধতিগত আত্মিক খুনের সাথে সমবেদনা করতে পারে না। কিভাবে একটা সমাজ দৈনিক অনেকগুলো আত্মিক খুনের আসামী হচ্ছে। মার্টিন লুথার কিংয়ের হত্যার পর জিমি এতটাই হতাশাগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল যে সে ১৯৬৮ তে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু সে তখন তার ক্যারিয়ারের তুঙ্গে। আমেরিকার সিভিল রাইটস মুভমেন্ট নিয়ে যে আশা সে দেখেছিল, তা যেনো কিংয়ের হত্যার পর সে আর খুঁজে পায় না। কারণ এর আগেই সে তার আরো দুই কাছের বন্ধু ম্যালকম এক্স ও মেডগার এভার্সকেও খুন হতে দেখেছে এই একই আন্দোলনের ফলে। তার এই বন্ধুর মৃত্যুর সাথে আমেরিকার বর্ণবৈষম্যের ইতিহাসকে একসাথে এনে তার একটি অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি ছিল, যার উপর ভিত্তি করে ২০১৬ তে মুক্তি পায় বহুল আলোচিত ডকুমেন্টারি “I am not your Negro”। ডকুমেন্টারিটি সে বছর বাফটাতে সেরা ডকুর পুরস্কারও জিতে। সেখানে দেখা যায় যারাই কালোদের মুখপাত্র হতে গিয়েছে তা ম্যালকম এক্সের মত কট্টর হোক কিংবা এমএলকে এর মত অহিংসবাদিই হোক, আমেরিকার কাছে তার পরিণতি একটিই। আফ্রিকান-আমেরিকানদের নিজেদের দুর্দশা নিয়ে কথা বলার কোন নেতা থাকতে পারবে না। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের শতবছরের নির্যাতনের কথা কেউ বলতে পারবে না। যেন তাদের নির্যাতনের ইতিহাসও ওই সাদারাই বলবে, আর তাদের মুক্তিও সেই জালেমই দিবে।

এসব সামগ্রিক পুর্বজ্ঞানের কারনেই বাল্ডউইন উদ্দেশ্যমূলকভাবে চাচ্ছে সাদা চামড়ার টেরির হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে৷ টেরির সেই জালেমের মেকি করুণার বিকৃত ইতিহাস ও মুক্তির ভন্ডামির ফাঁদে সে পড়তে রাজি নয়। এজন্যই এই জরুরী পুর্বজ্ঞান ছাড়া আপনি টেরির প্রতি জিমির বৈরীতা দেখে তা যুক্তিহীন, অতিপ্রতিক্রিয়া ভাবতে পারেন। কিন্তু ইতিহাস পড়ার বা সুনির্দিষ্টভাবে শোষণের ইতিহাস পড়লে সকল রকম অতিপ্রতিক্রিয়াও ন্যায়সঙ্গত মনে হয়। আমেরিকার ব্ল্যাক এক্সপেরিয়েন্সের জ্ঞান তাই জিমির ক্রোধকে সঙ্গত ও যথার্থ বানিয়ে ফেলে। যুগ যুগ ধরে চলা বিতর্ক ‘আর্টিস্ট বনাম আর্ট’ যেন উত্তেজনার আরেক স্তরে উন্নীত হয় জিমির শব্দের ভিতর দিয়ে। সাথে যুক্ত হয় সম্প্রতি চলা ঐতিহাসিক বিতর্ক— চার্লস এলেনের বিখ্যাত আর্টিকেলের শিরোনাম ‘Who owns India’s History?’ থেকে– মজলুমের উপর চলে জুলুমের ইতিহাস বলার অধিকার আসলেই কার কাছে আছে৷ মন থেকে ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে চলা শোষক শ্রেণীর জাতিগোষ্ঠীর কেউ কি কোন অবদান রাখতে পারবে সে ইতিহাসে? “হু ওউনস ব্ল্যাক’স হিস্টোরি?” 

এ প্রস্নের উত্তর বাল্ডউইন জানে – “তুমি (সাদা চামড়ার লোককে ঈঙ্গিত) ভাবো তুমি আমাকে জানো, কিন্তু তুমি আমায় জানো না৷ জানতে পারবে না কখনো। বরং উলটো, আমি তোমার সম্পর্কে কিছু জানি তা তুমি জানো না৷ তোমার গণতন্ত্র, প্রগতি যেসব বুলি আউড়ে তুমি নিজেকে নিয়ে গর্ব কর সেসবের ভণ্ডামি সম্পর্কে আমি জানি৷” এ কথা কি পৃথিবীর সকল মজলুম, সকল জালেমের সম্পর্কেই বলতে পারবে না? 

রাজনীতির বিপ্লব, বিপ্লবের রাজনীতি

এতটুক পড়ে যদি কেউ ভেবে থাকে এক রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় বাগ্মী তার দক্ষতা দিয়ে সেই শত বছরের শোষণের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিতে বসেছে, সেটা আংশিক সত্যি হলেও, ডকুমেন্টারি শুরু হওয়ার সময় পরিকল্পনা কিন্তু এমন ছিল না৷ ১৯৭০ এ যখন বানানো হয়, তখন টেরি ডিক্সন চেয়েছিল শুধু বাল্ডউইনের লেখার মাধ্যমে এই প্রভাবশালী লেখককে চিনতে৷ তার উপন্যাস নিয়ে কথা বলবে, কথা বলবে লেখক বাল্ডউইনকে নিয়ে। বাল্ডউইন রাজিও হয়েছিল, তার সেই এক্টিভিস্ট পরিচয় রেখে প্যারিসের লেখক জীবন নিয়ে কথা বলতে৷ কিন্তু ৬০ এর দশকের সিভিল রাইটস মুভমেন্ট এর সময় কোনো কালো লেখকের পক্ষে কি সম্ভব তার রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া কিছু সময় থাকা? তা সে আমেরিকার সাউথ এই থাকুক না কেন বা প্যারিসে? ডকুর শুরুতে এই কথা টেরি ভুলে গেলেও, বাল্ডউইন একটি মুহুর্তের জন্যও ভুলে না৷ যখন এই আন্দোলন শুরু হয়, তার কাছে কেবল রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক এই দুই বিকল্পের মাঝে বাছাই করতে হয় নি, তাকে আরো কঠিন একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। মূলধারার গণমাধ্যমে সে আগের থেকেই অনেক বড় ব্যক্তিত্ব ও লেখক। তারা সবসময়ই তাকে পর্যাপ্ত সম্মানই দিত, যতদিন না পর্যন্ত তার সেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়েও দুটি মতাদর্শিক ভেদ দেখা যায় যে কিভাবে সে স্বাধীনতা অর্জিত হবে। অহিংস উপায়ে হবে নাকি সহিংস বিপ্লবদ্বারা। আদর্শিক ভেদের একদিকে ছিল গান্ধী আরেকদিকে ছিল সাভারকার। কোনটি হওয়া দরকার ছিল, কেন দরকার ছিল, বাস্তবিকে কোনটি ফলপ্রসূ সে আলোচনা আরেক দিনের জন্য রইলো। যে প্রসঙ্গে এই কথা তুলে ধরা, তা হলো সিভিল রাইটস আন্দোলনের সময়েও কালোরা এই দুই বিভাজনে বিভক্ত হয়। এর একদিকে অহিংস মার্টিন লুথার কিং, আর একদিকে ম্যালকম এক্স বা ব্ল্যাক প্যান্থার গ্রুপরা। অপরদিকের ম্যালকমরা “ব্ল্যাক পাওয়ার” নামেও পরিচিত ছিল। আন্দোলনের প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল, তারা ধরে নিয়েছিল এই রকম পাশবিক অত্যাচারের ইতিহাসের সাথে শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হয় না, একে মূলোৎপাটন করতে হলে অস্ত্র হাতে তুলে নিতেই হবে। এখানেই বাল্ডউইনকে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়: সে কাদের পক্ষে যাবে। তার সিদ্ধান্তের আলাদা গুরুত্বও ছিল, কারণ সে এই আন্দোলনের অন্যতম অনুপ্রেরণা দানকারী। লেখক বা মুখপাত্র হিসেবে তাকে ফরাসি বিপ্লবের তুলনায় সিভিল রাইটস মুভমেন্টের ভলতেয়ার বললেও ভুল হবে না। সত্যিকারে তার ভূমিকা এই আন্দোলনে ভলতেয়ারের থেকেও বেশি ছিল। মূলধারার গণমাধ্যম, সরকার তাই চাচ্ছিল সে অহিংসদের পক্ষ নিক। কিন্তু সে নিলো ব্ল্যাক পাওয়ারদের পক্ষ। তার এই সিদ্ধান্ত তাই সহিংস নেতাদের সিদ্ধান্তের সাপেক্ষে কম সাহসিকতার ছিল না। সে ইচ্ছাকৃতভাবে তার লেখক হিসেবে খ্যাতির ঝুঁকি নিয়েছিল। “Begin Again” নামক বাল্ডউইনের জীবনী লেখক, প্রিন্সটন বিশ্বিদ্যালয়ের প্রফেসর এডি গ্লাউদের মতে, সে যদি এই সিদ্ধান্ত না নিত, সে সাহিত্য নোবেল নিশ্চিতভাবে পেত। বাল্ডউইন নিজেও জানতো কিরকম ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তাও সে ভয় পায়নি সিদ্ধান্ত নিতে। তার যুক্তি ছিল, যে জাতিই হোক না কেন, সে আইরিশ, ইহুদি, পোলিশ, সে যদি তার নিপীড়কের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়, সে বাহবা পায়, তাকে হিরো বানানো হয় পশ্চিমে বা পৃথিবীর সবার জন্য। সে হয়ে যায় বিপ্লবী, সবার আদর্শ। কিন্তু কোনো কালো হাতে অস্ত্র নিলে সে অপরাধী, জঙ্গি, অসভ্য। সেই একই পশ্চিম যে অন্যদের অত্যাচারীর বিরুদ্ধে বিপ্লবী হওয়ার জন্য প্রসংশা করে স্বর্গরাজ্যে নিয়ে গিয়েছে, তারাই আবার কালোদের পারলে একই কারণে পাতালে এনে ফেলে। পশ্চিমের এই রাজনৈতিক বিপ্লবীর দ্বৈত আচরণ এখনো প্রাসঙ্গিক। নিজের দেশে এখনো সেটা চামড়ার রং দিয়ে মাপকাঠি করা হয়, বাইরের জন্য কে বিপ্লবী কে বিপ্লবী না, সেই লিটমাস টেস্ট হয় পশ্চিমের রাজনৈতিক স্বার্থ দিয়ে। আরো একটি কারণেও সেটি প্রাসঙ্গিক। লেখকরা শুধু নয় শিল্পীরাও, যারা সমাজের বিবেককে জাগ্রত করার দায়িত্ব নিয়ে শিল্পী তকমা নেয়, তারা পেশাগত সুবিধার জন্য, কিভাবে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় ছুড়ে ফেলে দেয়। সমাজে এখন তাই শুধু ঝুঁকি নিতে না চাওয়া অরাজনৈতিক শিল্পীদের, সমাজের অবিচার, অত্যাচারের সাথে এক অভূতপূর্ব শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। বাল্ডউইন সেখানে ক্যারিয়ার, নোবেলের তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ উল্টো পথ বেছে নিয়েছে, এ সময়ের তথাকথিত নিরীহ নির্বিষ শিল্পীদের তাই অনেক শিখার আছে বাল্ডউইনের কাছ থেকে।

অস্কারজয়ী সিনেমা “Moonlight” পরিচালক বেরি জেনকিনস তাই সবাইকে বলে বাল্ডউইনকে পড়তে। অনেক সমালোচক ও সিনেমা অনুরক্তরা মুনলাইটের গল্পে বাল্ডউইনকেই খুঁজে পায়। মূলচরিত্রে শিরন নামের চরিত্র যেনো জিমির বহিঃপ্রকাশ: কালো ও সমকামী। এই থিওরি আরো দৃঢ় হয় যখন বেরি জেনকিনস তার ঠিক পরবর্তী সিনেমার জন্য জিমির নোভেল “If Beale Street Could Talk” কে বেছে নেয়। 

মুখোমুখি প্রিয় লেখক

Meeting the Man: James Baldwin in Paris” ডকুর এই কল্পনাতীত শুরুটা যেকোনো পরিচালককে ঘাবড়ে ফেললেও, টেরি ডিক্সনকে পারে নি। প্রিয় লেখকের এমন ব্যবহারে ক্ষণিকের জন্য বিচলিত হলেও মাঝেই একপর্যায়ে টেরি তার প্রিয় লেখককে জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হয়, ক্যামেরা চলাকালীন অবস্থাতেই, কেন এমন অসহযোগিতা পাচ্ছে সে ও তার টিম, জিমির আগের সম্মতি থাকা সত্বেও। এখানেই ডকুটি আমার প্রিয় ডকুমেন্টারি ট্রিটমেন্ট পায়— অনাকাঙ্ক্ষিত নাটকীয় মোচড়৷ 

মুভির ক্ষেত্রে ড্রামাটিক টুইস্ট খুব স্বাভাবিক বা কার্যকর একটা উপায়৷ যদিও অনেক নান্দনিক, বা নন্দন শব্দটি বহন করতে না চাওয়া ফিল্মানুরাগীরা এই কৌশলকে অপছন্দ করে৷ আদতে অপছন্দ করার কারণ না থাকলেও, যেভাবে যুক্তির বালাই ছাড়া যাচ্ছেতাই এটির অতিব্যবহার হয়েছে, তাই কিছুটা হলেও উল্লিখিত শ্রেনির কাছে এই কৌশল মর্যাদা হারিয়েছে৷ তবে কেবল ডকুমেন্টারির জগতে এই কৌশল সর্বোচ্চ রকম কার্যকর এখনো, এবং সবসময়েই থাকবে কারণ – স্বয়ং পরিচালক বা নির্মাতা কেউই জানেনা কখন সে মোড় আসবে বাস্তবের কোন ঘটনায়৷ আপনি হাজার চাইলেও যেমন জীবনে বা বাস্তবতায় নাটকীয় পরিবর্তন আসে না, আবার না চাইলেও ধুপ করে সে পালাবদল এসে আপনার জীবন উলটপালট করে দেয়। তাই এই অকাঙ্খিত মোড় নেওয়া বাস্তবিক ক্লাইমেক্স যা প্রাত্যহিক দৈনন্দিন জীবনে পাওয়া যায়— আর্টিস্টিক ছবি ফরম্যাটে তা আপনি শুধু ডকুমেন্টারিতেই পাবেন৷

ঠিক তাই টেরি যখন বাল্ডউইনের বৈরী অনমনীয়   আচরণের মুখোমুখি হয়, একই সাথে আমরাও টেরির মত অবাক হই এই নাটকীয় বাঁক বদলে৷ আর সেই নাটকীয় টার্ন চরমে পৌছায়— ফরাসি বিপ্লবের মতো— বাস্তিল মনুমেন্টের সামনেই৷ টেরিকে ধরে সমগ্র পশ্চিম সভ্যতাকে আক্রমণ শুরু করে বাল্ডউইন –

“যখন তারা (বিপ্লবীরা) এই কারাগারকে ভেঙে ফেলে, সেটা ইউরোপের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, এবং ইউরোপ সে ঘটনার মাহাত্ম্য সম্পর্কে অবগত৷ আমিও একটি কারাগার ভাঙার চেষ্টায় আছি, যে ঘটনা ইউরোপীয় চিন্তায় এখনো ঘটে নি৷ কারণ ইউরোপের চোখে আমি এখনো অসভ্য৷ যখন কোন সাদা ব্যাক্তি তার কারাগার ভাঙে, সে তাকে ‘মুক্ত’ বা ‘স্বাধীন’ করতে চায়৷ কিন্তু আমি যখন কারাগার ভাঙি, আমাকে সাথে সাথে বর্বর ভাবা হবে৷ কারণ তোমরা কখনই বুঝবে না, যে তোমরাই আমার কারগার৷ তুমিই আমার কারাগারের প্রহরী৷ আমি তোমার বিরুদ্ধেই লড়াইরত৷” 

লেখকদের নিয়ে যথেষ্ট ডকুমেন্টারি দেখা, আলাদা করে সিভিল রাইটস মুভমেন্ট নিয়েও অনেক ডকুমেন্ট দেখা সত্বেও, কখনো দেখিনি এর নির্মাতা এরকম রুপক আক্রমণ এর মুখ্য বিষয় হয়ে যায়৷ কখনো পরিচালক বিগত হয়ে যাওয়া তার প্রিয় লেখকের পরস্পরবিরোধী স্বভাব আবিষ্কার করেছে, কখনো দেখেছে তার প্রিয় লেখক মানুষ হিসেবে কতটা দোষেগুনে ভরপুর। আর সিভিল রাইটস মুভমেন্ট নিয়ে যারাই কাজ করেছে তারা আরো সমর্থন পেয়েছে কালোদের থেকেই। কিন্তু এখানে টেরি তার প্রিয় লেখক এবং সিভিল রাইটস নিয়ে লিখা প্রিয় লেখকের কাছে এসেও বিচলিত এই অতর্কিত রূপক আক্রমণে৷ বাল্ডউইন শুধু না, বাল্ডউইনের আশেপাশের সবার মাঝে টেরি ও তার ক্রুরা অবিশ্বাসের গন্ধ পাচ্ছে আর সেই অবিশ্বাস শেষ পর্যন্ত অনুভব করা গিয়েছে। ডকুর শেষ দিকে টেরির প্রশ্নের উত্তরগুলো ঠিকভাবে দিলেও, ডকুমেন্টারির সাবজেক্ট ও তার পরিচালকের মাঝে এমন অনুভবযোগ্য টেনশন আমি আর কখনো দেখি নি৷ 

এই স্পষ্ট টেনশন কি টেরির আশা করাই উচিত ছিল না? 

আমি এখানে টেরির পক্ষপাতিত্ব করতে চাই৷ আমার কাছে ২৭ মিনিট শেষে যখন এন্ড ক্রেডিট উঠে, ক্ষণিকের জন্য পর্দায় না আসা টেরিকেও ট্রাজিক এক চরিত্রই লাগছিল – যে তার প্রিয় এক লেখককে আরেকভাবে আবিষ্কার করে৷ কিন্তু টেরি যদি সত্যিকারের ভক্ত হয়ে থাকে মানুষ বাল্ডউইনের, সে খুশিই হবে৷ বাল্ডউইন তো আসলেই এমন– অনাকাঙ্খিত, এলোমেলো, বিশুদ্ধ, সত্য, সাথে তার সবচেয়ে বড় দুই পরিচয়: কাল এবং পলিটিকাল৷ বাল্ডউইন প্রফেটদের মতো সার্বজনীনও। আমেরিকার বর্ণবাদকে কেন্দ্র করে তার সব কাজ বা জীবন হলেও, তার কথা পৃথিবীর সকল শোষণ ও অন্যায়ের ক্ষেত্রেই অনুরণিত হয়। বর্তমানের সাথে যেন আরো জোরে হয় সেই প্রতিধ্বনি। এজন্য বর্ণবাদের উপর নির্মিত ভুরি ভুরি মুভির মাঝে ২৭ মিনিটের ‘মিটিং দ্য ম্যান’ হলো বিশুদ্ধ, জীবন্ত ও বাল্ডউইনের মতই পৌরাণিক৷ 

লেখকঃ আবু জর গিফারি, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।