শিল্পকথা   

আয়শা নাজমিন 

সেদিন বৃষ্টিতে ছাতা বিহীন আমি কোথাও ছাউনি খুঁজছিলাম কিন্তু পেলাম না। মনের আনন্দে ভিজতে মন চাইল। বাহ! কি সুন্দর বৃষ্টি, কিন্তু জ্বর আসলে বিষয়টা আর সুন্দর থাকেনা। কোনমতে একটা টং এর দোকানের কাছে দাঁড়ালাম। এক ভদ্রলোক সরে দাঁড়ালেন। সামনে দেখি একটা বইয়ের দোকান। কি সুন্দর করে সাজানো। রুচি আছে দোকানদারের বলাই বাহুল্য। মনে মনে ভাবলাম আসলে মানুষের সৃজনশীলতা এবং কল্পনার প্রকাশ বা প্রয়াস, মূলত তাদের সৌন্দর্য ও চিন্তাভাবনার জন্যই প্রশংসিত।

সুন্দর কোনো কিছুর কথা ভাবতেই মনের অজান্তে “শিল্প” ধারণাটা আসে। আচ্ছা শিল্প কি? জানেন তো? আসলে আমিও ঠিক জানিনা। একটু ভাবা শুরু করলাম। এদিকে ঝুম বৃষ্টি! আমি প্রথম যেবার আর্ট গ্যালারিতে গিয়েছিলাম তখন সেই পর্যায়ে যা দেখেছি, গ্যালারিতে থাকায় আমি সেগুলিকে শিল্প ভেবে নিয়েছি স্বভাবতই । কিন্তু এর সংজ্ঞা আমার জানা ছিলনা তখন। তাই আমি শিল্পের একটি সংজ্ঞায় পৌঁছতে শুরু করি।

প্রথমেই মনে হল যে, শিল্প বিশ্বকে আঁকড়ে ধরে রাখার একটি উপায়। কারণ শিল্পের আবির্ভাব প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে, শহর এবং সভ্যতার অনেক আগে, তবুও আমরা এখনও সরাসরি সম্পর্ক করতে পারি। ফ্রান্সের লাস্কাউক্স গুহার দেওয়াল চিত্র গুলি, যা সকলকে চমকে দিয়েছিল; যেগুলো কত রকমের চিহ্ন, কত রকমের চর্চার কথা বলছিল। সভ্যতায় বিস্তৃত মান বজায় রাখার জন্য শিল্প আসলেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

মানুষ জন্ম থেকেই অনুকরণপ্রিয়। সাধারণ মতে এই অনুকরণের প্রবৃত্তি হতেই হয়তো শিল্পের জন্ম। তবে অনেকের মত গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর মতে একে কেবল অনুকরণাত্মক বলা যুক্তিসঙ্গত নয়। শিল্পীর মনের স্পর্শ বিহীন অনুকরণ কেবলই যান্ত্রিক, তা কখনই শিল্প হতে পারেনা। শিল্পের সাথে মনের সংযোগ অবশ্যম্ভাবী। এটি শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শিল্প ক্ষণস্থায়ী জীবনের চঞ্চল স্রোতকে ক্ষণ-সৌন্দর্যের মাঝে বন্দী করে স্থিতিশীলতা দান করে; কারণ জীবনে থাকে চঞ্চলতা আর শিল্পে স্থিতি। জীবন শেষ হয়ে যায় কিন্তু শিল্প এই সসীম জীবনের ক্ষণ-সৌন্দ্যর্যটিকে শান্ত শ্রী দান করে চিরদিনের করে রাখে। সুতরাং শিল্প চলমান জীবনের স্থিতিমান মুহূর্তের চিরন্তন প্রকাশ। এটি একটি নান্দনিক প্রতিক্রিয়া, যোগাযোগের একটি মাধ্যম ।

শিল্পের অর্থ বহুমুখী এবং চলমান। এমনকি একটি মতানৈক্য, উত্তেজনা যা নিজেই কিছু একটার অভিব্যক্তি। শিল্পের একটা কাজ যা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে, নিরেট একটা প্রাচীর প্রশ্ন করে না। এটি হল মানুষের সৃজনশীল বা কল্পনা প্রবণ ক্রিয়াকলাপের বৈচিত্র্যময় পরিসর, যা প্রযুক্তিগত দক্ষতা, সৌন্দর্য, মানসিক শক্তি, বা ধারণার প্রকাশক।

বইয়ে পড়েছি, জেনেছি, শিল্পকলার ঐতিহ্যগত বিভাগগুলির মধ্যে রয়েছে সাহিত্য; পশ্চিমা ঐতিহ্যে, দৃশ্যকলা শিল্পের তিনটি শাস্ত্রীয় শাখাঃ গ্রাফিক আর্টস (পেইন্টিং, অঙ্কন, নকশা, এবং ফ্ল্যাটে প্রকাশ করা অন্যান্য ফর্ম), প্লাস্টিক আর্টস (ভাস্কর্য, মডেলিং), আলংকারিক কলা (এনামেলওয়ার্ক, আসবাবপত্র ডিজাইন, মোজাইক ইত্যাদি); পারফর্মিং আর্টস (নাট্যকলা, নৃত্য, সঙ্গীত), এবং স্থাপত্য। এসব আমাদের চিন্তাভাবনা, আবেগ, অন্তর্দৃষ্টি এবং আকাঙ্ক্ষার এক একটি অভিব্যক্তি, তবে এটি তার চেয়েও বেশি ব্যক্তিগত: এটি ব্যক্তিত্বের একটি সম্প্রসারণ। এটি অন্তরঙ্গ ধারণা গুলির যোগাযোগ যা শুধুমাত্র শব্দ দ্বারা বিশ্বস্তভাবে চিত্রিত করা যায় না। এবং শব্দ একা যথেষ্ট নয়, আমাদের অভিপ্রায় বহন করার জন্য অন্য কোনো বাহন খুঁজে বের করতে হয়।

শিল্পের নিয়ম আছে আবার নেই। সময়ের সাথে কিছু নিয়ম হয়ে আবার সে নিয়ম ভেঙে নতুন নিয়ম হয়েছে। শিল্পে এই নিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থানও নিয়েছে অনেক শিল্পী। শিল্প হল মতামত বা অনুভূতি প্রকাশ করার একটি উপায়, অন্যথায় বিশ্ব-জগতের আরেকটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা, যা অনুপ্রাণিত করবে সম্পূর্ণ নতুন কিছু উদ্ভাবিত করতে। এটি আপনাকে এমন জিনিস সম্পর্কে ভাবতে বা বিবেচনা করতে সাহায্য করে যা আপনি ইতোপূর্বে চান নি বা কখনও ভেবে উঠেন নি। যদি তা আপনার মধ্যে আবেগ বা ভাবের উন্মেষ ঘটায়, তবেই তা শিল্প।

শিল্প সভ্যতার বিকাশকে চালিত করে, সভ্যতার প্রতিষ্ঠা ত্বরান্বিত করে– শিল্প নেতৃত্ব দেয়, আয়না দেখায় এবং রাজনীতি ও নৈতিকতার বিবর্তন সে আয়নায় বিম্বিত হয়। শিল্প সংস্কৃতির পরিগঠনে অনুঘটক হিসেবে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, আড়ম্বরের সাথেই; শিল্প ভাষা এবং সময়ের বাইরে যোগাযোগ করতে পারে, আমাদের সাধারণ মানবতার কাছে আবেদন করতে পারে এবং ভিন্ন সম্প্রদায়কে সংযুক্ত করতে পারে। সম্ভবত যদি বৃহৎ শ্রোতাবর্গ বিশ্বের শৈল্পিক ঐতিহ্যের বৃহত্তর বৈচিত্র্যের সাথে জড়িত থাকে তবে এটি সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা বৃদ্ধি করতে পারে।

এক কাপ চা নিলাম। চায়ের উষ্ণতা উপভোগ করতে করতে ভাবলাম শিল্প নিয়ে এভাবে হয়তো অনেক ভাবনাই আসতে পারে, কিন্তু আসলে শিল্পের সংজ্ঞা কী? আমি বিশ্বাস করি যে, শিল্প, যা বিশ্বকে নতুন করে দেখার চেষ্টা করায়, যা কখনও কাউকে আঘাত করেনা, মানুষকে ভাবায় , ভাবতে শেখায়। আর যিনি শিল্প চর্চা করেন তিনি মনুষ্যত্বের গুণাবলী ধারণ করেন, তিনি সমাজে বিপ্লবী একজন ব্যক্তি হয়ে উঠেন যার মধ্যে কোনো হিংসা থাকবেনা, অন্যকে ধ্বংসের চিন্তা থাকবেনা। থাকবে শুধু সমাজের উন্নতি সাধন, সভ্যতার উন্নত থেকে উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কৌশল ও চিন্তা ভাবনা।

আমাদের ব্যক্তিত্ব, আমাদের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের কারণে, আমাদের বিতর্ক সবসময়ই নিষ্পত্তিহীন থাকবে। আমরা যদি জ্ঞানী হই, তবে আমরা নির্বিঘ্ন চিত্তে তাকাব এবং শুনব, এবং কখনও কখনও মৃদু হাসি দিয়ে, সর্বদা মানুষের কল্পনা এবং কৃতিত্বের বৈচিত্র্য উদযাপন করব। শিল্প হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে এবং যুগে যুগে এটি বিভিন্ন উপায়ে বিকশিত হয়েছে। শিল্প তৈরি করার হেতু ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে পরিবর্তিত হয়, বিশেষ কিছু পরিস্থিতি ও প্রতিবেশের উপরও নির্ভর করে, তাই শিল্পকে সংজ্ঞায়িত করা বেশ জটিল, আর ইতিহাসের শুরু থেকেই শিল্প সক্রিয় তর্কবিতর্কের মধ্যদিয়ে এগিয়ে গেছে। সেখানে সহজ একমুখী কোন সংজ্ঞা নেই। তবে অনেকের বিশ্বাস, শিল্প এমন কিছু যা আপনার মধ্যে ভাবাবেগ সঞ্চারিত করে। এই ভাবাবেগ সম্পূর্ণরূপে আপনার ইতিহাস, আপনার গল্পের উপর নির্ভর করে, মূলত এমন সবকিছু যা “আপনি কে”, সে পরিচয় তৈরি করতে জড়ো হয়। এটি আমাদের গল্প বলার, ইতিহাস রচনার এবং আমাদের আবেগকে এমনভাবে বন্ধনে আবদ্ধ করার সুযোগ করে দেয় যা অন্য কিছুর পক্ষে সম্ভব নয়। বছরের পর বছর ধরে, অনেক লোক শিল্প কী বা কী নয় তা শ্রেণিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। এই মুহূর্তে আমিও হয়তো করলাম।

ভাবতে ভাবতেই বৃষ্টি শেষ! একটি সুন্দর ও শৈল্পিক চিন্তা এক মুহূর্তে ইতি টেনে মনের কল্পনাকে ভাষা দিয়ে চলেছিলাম আমার প্রিয় ক্যাম্পাসের দিকে, আমি হাঁটছি, কল্পনার ভাষায় কথোপকথন করছি— একটি যাত্রা অনুপ্রাণিত, চিন্তায় আঁকা এবং স্বপ্নে ঘেরা।

লেখকঃ আয়শা নাজমিন, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়