শনিবার

আল ইমরান

রাত যখন শেষের দিকে আসলো, রাতকে মনে হচ্ছিলো ভোর। মেলাটানিনের প্রভাব? গতরাতে এক ফোঁটা ঘুমাইনি। মোবাইল টিপেছি। পরে যখন একসাথে অনেক পাখি ডাকল গাছে, আকাশে, দুই-তলায় আজান দিলো, তখন বুঝলাম সকাল হয়েছে। ‘কতদনি সকাল দেখা হয় না!’ —সুখ নিয়ে এমন আফসোসে করার সুযোগটা পেয়ে গেলাম আজকে, রাতকে সকাল বানিয়ে।

বের হলাম। কোনো রহস্য-বারান্দা অতিক্রম করছি নাকি, সামনে এমন আঁধার আর আলো। বেলার প্রতিবিম্বটা উড়ে আর হামাগুড়ি দিয়ে আগাচ্ছে হলের বারান্দা থেকে। ঢুকে পড়লাম তার ভেতরে। হল গেইট পর্যন্ত আসতে আসতে আরো অনেকেই বের হয়েছে ওই আলো-আঁধার থেকে, সিড়ি বেয়ে। মুসল্লিরা, বড় বড় জামা পাজামা পরা, অন্যদিকে আমার পরনে হাফপ্যান্ট ও টিশার্ট, আমাকে তারা দেখছে, আমি তাদের দেখছি।

তারপর আগাই। এখন চোখ গিয়ে পড়লো হলের সামনের পুকুরে। পানির উপরে শ’খানেক বক উড়ে বেড়াচ্ছে। পুকুরে তখনও পুরোপুরি আলো পৌঁছায়নি, আলো-আঁধারে সাদা সাদা বকগুলো আরো সাদা। চোখের ফোকাস আঁটকাচ্ছে এখন। আমি কল্পনা করলাম, সামনে একটা ছোট্ট কুটির। ব্রিজ পার হয়ে ওখানে যেতে হয়। ওখানে বগী। রাতে সে মাছ পাহারা দেয়। মানুষ নেমে গপাগপ খেয়ে ফেলে কিনা দেখে। আমি তাকে এখন বলতে যাবো, ও বগী তুই খাস কী? বগীটা বলবে, পান্তা ভাত তুই খা। 

এরা সবাই এসেছে এখানে মাছ খেতে। স্বচ্ছ পানিতে তেলাপিয়া, কারফ্যু মাছেরা পানির উপরে মুখ বের করে কিছুক্ষন পর পর এক জায়গায় এসে দল হচ্ছে। আর সুযোগ সন্ধানী বকগুলো উড়ে এসে ছোঁ মেরে ঠোঁটে করে মাছ নিয়ে যাচ্ছে, আর মাছেদের দলভঙ্গ হচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা আমার একটা খেলা মনে হলো, লুকোচুরি খেলা। মাছ পানির উপর এসে কুউউ দিচ্ছে আর বক এসে তাদের ধরে ফেলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই খেলায় অংশ নেয় একটি সাপ। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটেছে, সূর্যের আলো পানি ভেদ করে পড়ছে হলুদ আর কালো রঙের ডোরাকাটা জল ঢোঁড়া সাপের উপর। সে-ও এসেছে মাছ খেতে। অপরুপ সুন্দর এই সাপটি অত্যন্ত নিরিহ এবং নির্বিষ, একথা ভেবে গ্রামের গরীব ঘরের গজ কাপড়ের বানানো সেলোয়ার-কামিজ পরা কাজল চোখের কোন সুন্দরী মেয়ের কথা মনে পড়লো।

সাপ মাছ ছাড়া আর কি খায়? ব্যাঙ খায়। সাপ কবে থেকে উভচর হলো?  কুইক-কুইজ। সাপের কখনো মাছের মতো পাখা ছিলো কি? পাখা না থেকেও সাপ এতো ভালো সাতার কাটে কীভাবে? খেলতে খেলতে পাশে তাকাচ্ছি, দেখি সাপটি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পাড়ে  উঠে এসেছে, আমার খুব কাছাকাছি। যত কাছে আসছে, তত ভয় লাগছে। এই নির্বিষ সাপকে আমি এখন আমার শত্রু ভাবা শুরু করলাম। সাপও কি আমাকে শত্রু ভাবছে নাকি?

এতো ভাবা-ভাবি করছি না, এক্ষুনি কি দিবে নাকি কামড়, এই ভেবে জুতা ফেলেই দেই দৌড়। এই ঘটনায় আমি ভয় পেলেও বেশ আনন্দ পেয়েছি। কেন পেয়েছি জানি না। সুন্দর তাহলে কী ব্যাপার আমার কাছে, যতক্ষণ না কিছু অস্তিত্বের জন্য হুমকি? বকগুলো? যেগুলো সাদা-সাদা? ও যেগুলো আরো সাদা ছিল আলো-আঁধারে? ওরা ওদের চোখ দিয়ে কেমন দেখছে আমাকে? মাছগুলো কেমন দেখে বকদের? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ধুপ করে শব্দ হলো। কিসের মধ্যে কী! ধুপ করে একটা কাঠবিড়ালির বাচ্চা পড়ে গেছে সামনের গাছটার নীচে। ওরা যেমন দেখে দেখুক, কুইক কুইজ বন্ধ। ওটাকে প্রথমে তুলতে হবে। কাঠবিড়ালির মা’টা কইরে!

লেখকঃ আল-ইমরান, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইন্জিনিয়ারিং (সিএসই), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়