বৃশ্চিক

সিয়াম আল জাকি

যেখান থেকে আসলে পথচলা শুরু আমার। না এভাবে বলবো না। আমার মধ্যে এখন আর আমি বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নাই।  বাথরুমের আয়নার সামনে যে দাড়িয়ে আছে তাকে আমি বলতে ইচ্ছে করছে না। সে-সকল মূহুর্ত যেগুলো মনে পড়লে ক্রমশ বিব্রত ভাব একজন মানুষকে জড়িয়ে ফেলে ঠিক সে সকল ঘটনা বা মূহুর্তের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয় আমার মাঝে মাঝে। 

এই যে এখন আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছি কোনো কারণ ছাড়া। নিজেকে দেখতে চাচ্ছি। কিন্তু, নিজেকে যে রুপে দেখছি তা ভালো লাগছে না। আমি যে রুপে নিজেকে দেখতে চাচ্ছি সেই রুপে নিজেকে দেখতে পাচ্ছি না। নিজের দোষ খুঁজে পাওয়ার মতো মহানুভবতা আমার মধ্যে নাই। তাই আমার মনে হচ্ছে এটা আয়নার দোষ। পুরনো আয়না হয়ে গেছে ঝাপসা।

মনে পড়ছে স্কুলের ঘটনার কথা। স্কুলে সেদিন কিছু একটা প্রোগ্রাম ছিলো বোধহয়। আলী স্যারের ব্যস্ততা ছিলো চোখে পরার মতো। আমি নিজে এসবে কোনোদিনই খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি নাই। এসব হয়না আমারে দিয়ে আসলে। স্কুলের দোতলায় যে পাশে টিচার্স কমন রুম সেখানে গিয়ে লক্ষ্য করলাম তাসফিয়া দাড়িয়ে আছে মুখ ভার করে। কিছু মানুষ আছে যাদের মন খারাপ করা চেহারার অদ্ভুত এক আকর্ষণ থাকে! যার আসলে কোনো ব্যখ্যা নাই। মনে হলো জিজ্ঞেস করা উচিত কী ব্যপার এই সময়ে এখানে কেন। জিজ্ঞেস করতে তার খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছি ঠিক সে মূহুর্তে জান্নাতকে দেখলাম তাসফিয়ার কাছে চলে এসেছে সে। আর তার সাথে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। তবুও কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করে ফেললাম। জান্নাত আর তাসফিয়া দু’জনই আমার স্কুল বন্ধুর মতো ছিলো। লক্ষ্য করলাম জান্নাত চাচ্ছে দাড়ায় থাকার  কারণটা সরাসরি আমাকে জানাতে। কিন্তু, তাসফিয়া বোধহয় চাচ্ছে না এমনটাই মনে হয়েছিল তখন। কিছুক্ষণ বাদে শুনলাম শারমিন ম্যাডাম তাদের দুজনকে ডাকছে। তারা চলে গেলো। 

তারা দুজন চলে যাওয়ার পর লক্ষ্য করলাম নিজের ভেতর এক শূন্যতার অস্তিত্ব। নিজের কাছে ক্রমাগত একটা প্রশ্ন আসছে। ঐ যে ঠিক সেই সম্পর্ক, বন্ধু নামক আবেগ থেকেও যার প্রভাব বেশী যে প্রভাবের ফলে ঐ বাধাটা আর থাকেনা যে বাধার ফলে কোনো কথা বলতে সংকোচ হয় না, সেইরকম সম্পর্ক কী আমার আদৌ আছে?

এমন সব শূন্যতা আর ঘটনার কথা মাঝে মাঝে পীড়া দেয়। বেশ কিছু বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও মনে থাকে কিছু মূহুর্ত। তাসফিয়ার সাথে এরপর কত যোগাযোগ হলো কতো আড্ডা দেওয়া হলো। নিজের পথ বেছে নেওয়ার যুক্তির কাছে যোগাযোগকে বিসর্জন দিয়ে এগিয়ে চলা হলো। আজ মূহুর্তটি পেরিয়ে যাওয়ার প্রায় দশ বছর হয়ে এলো তারপরেও কেন যেন ঠিক নিজেকে আয়নায় দেখে বিব্রত বোধ করছি আমি। 

সকালে উঠে অফিস যাওয়ার সময় যতোসব অদরকারি কাজকর্মের কথা রেশমির মনে পড়ে যায়। কোন তরকারি আনতে হবে, মাথায় দেওয়ার জন্য তেল আনতে হবে এসব ছোটো কাজের কথা তার তখনই মনে হয়। হেঁয়ালিপনার একটা সীমা আছে। মনে মনে গজগজ করতে থাকি। কিছু বলতে গেলে ছোটো কোনো বিষয়কে বড় করার নিজের যে অসীম দক্ষতা তা রেশমি আমাকে জানিয়ে দেয়। অথচ তার মাথায় রাখা উচিত যে অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। দোকান খোলা থাকে না বাজারেও কোনো লোক থাকে না। শূন্য দোকান আর বাজারের দিকে তাকিয়ে তখন আমার মনে হয় আমার ব্যর্থতার জন্য আজ রেশমির বলে দেওয়া জিনিসপত্র আনা হলো না। নিজের বসকে তোষামোদ করে ভালো সম্পর্ক বানিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে না আসতে পারার ব্যর্থতা। এই মহান গুণটি আমার নাই। অনেকের আছে। আমি তাদের দেখি। ভাবতে থাকি এরা এসব কীভাবে করে ফেলে। এতো আগ্রহ তারা কী করে পায়। বসের থেকে ঝাড়ি খেয়ে কীভাবে এতো তাড়াতাড়ি আবার বসের গুণগান গাওয়া শুরু করে।

রেশমি খুব একটা অবুঝ মেয়ে না। যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে। এই সময়ে তা না হলে চল্লিশ হাজার টাকায় সংসার সামলানো সহজ কথা না। দুই ছেলে আছে আমাদের । একজন কলেজে পড়ে অন্যজন স্কুলে। দুইজনই সায়েন্স পড়ে। তাদের দুজনকে পড়াশোনা করানোর পেছনে অনেক টাকা চলে যায়। শিক্ষার পেছনে সব টাকা ঢেলে দেওয়ার পর যা বেঁচে থাকে তা দিয়ে সংসার চালানো কতটা কঠিন তা আন্দাজ করা যায় খুব সহজে। রেশমির প্রতি ঠিক এসব কারণে আমার কৃতজ্ঞতা আছে। মাঝে মাঝে আমাকেও টাকা ধার করতে হয়। পরের মাসে তা শোধ করার জন্য ওভার টাইম করতে হয়। এর মাঝে কেউ অসুস্থ হয়ে গেলে মাসের খরচ বেড়ে যায়। তারপর আবার টাকা ধার আর তা শোধ করার জন্য ওভার টাইম। এভাবেই চক্র চলতে থাকে। 

কিন্তু, আমার মনে হয় না এভাবে দিন কেটে যাবে। ছেলে দুটো আছে। এদের দিয়ে অবশ্যই ভালো কিছু হবে। দুটোই বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য পড়তে যাবে৷ আমার ভাবনা আমেরিকায় পড়তে গেলে বেশী ভালো হয়। সিটিজেনশীপ একবার পেয়ে গেলে তো কথায় নাই। তাই দুজনকেই বলে দিয়েছি যে দেশের বাইরে পড়াশোনার জন্য যেতে হবে এটাই শেষ কথা। আইইএলটিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। মাঝে মাঝে ভাবি আমাদের সময় আমরা এসব চিন্তাও করতে পারতাম না। তখন ভাবতাম বড়লোকের ছেলেমেয়েরাই কেবল পড়ালেখার জন্য বিদেশে যায়। সময় কত দ্রুত পাল্টে যায়! আমার মনে হয় বাংলাদেশে ভালো কাজ বলতে যদি কিছু হয়ে থাকে তাহলে এই কাজটাই হয়েছে। পরিস্থিতি ও প্রত্যাশার বিবর্তন বোধহয় একেই বলে। 

আজ বাস ধরতে পারিনাই ঠিক সময়ে। বাসের জন্য দাড়ায় থাকার সময় ছিলো না হাতে। অদ্ভুত সময় যায় মাঝে মাঝে। মোড়ে দাড়ায় থাকা অবস্থায় নিজেকে সবচেয়ে হীন কীটের মতো মনে হয়। মানুষের সাথে আমি দাড়ায়ে আছি রাস্তায়। এতো কোলাহলের মধ্যে নিজের কেউ নাই। রাস্তায় কোনো পরিচিত জনের সাথেও দেখা হয় না আজকাল আর। এসব হলো আসলে চল্লিশ বছর যে একজন মানুষের হয়ে গেছে তার লক্ষণ। মনে পড়ে যায় এতো কোলাহলের মাঝেও বয়স যখন ছিলো বিশ, বাইশ বা তেইশ তখন কোনো না কোনো পরিচিত লোকের সাথে দেখা হয়ে যেতো। দেখা হয়ে যাওয়ার পর সময় চলে যায় আমার কোনো খবর নাই। বাসায় কোনো কাজ ছিলো হয়তো তার কথাও বেমালুম ভুলে যেতাম। 

বাস ধরতে না পারার হতাশায় আর অতীত স্মৃতির তরফে নমি ছুড়ে দিয়ে সিএনজি নিয়ে ফেলি। বাড়তি টাকা খরচ হয়ে গেছে এই চিন্তাও সে সকল ভাবনাকে তখন সঙ্গ দেয়। 

অফিসে কাজের চাপ বেশী আজ। বয় থেকে শোনা গেলো বসের মুড আজ বেশ খারাপ। বিপদ যখন আসে তখন একদম বেশী করে আসে। বয়গুলো আসলে যতোসব বাজে লোক। যদিও বাজে বলেই হয়তো তারা এই কাজ করে। তা না হলে এসব কাজ করার জন্য কেউ খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করার কথা না। তো হয়েছে এদের মধ্যেই কেউ আজ বসের টেবিলে ভুলে চা ফেলে দিয়েছে। টেবিলে কিছু জরুরী কাগজ ছিলো। বসের সামনেই এই ঘটনা খুব তাড়াতাড়ি ঘটে যায়। তৎক্ষনাৎ বস সেই বয়কে ঝাড়ি মারা শুরু করেন। গায়ে হাত যে উঠাননি এটাই বয়ের সৌভাগ্য। তো বসের গলা যতো চড়ছিলো ঠিক ততোই স্টাফদের মনে ভয়ের পরিমাণও বাড়ছিলো। এমনিতেই অফিসে কাজের চাপ বেশী তার উপর বসের মেজাজও চড়া। সব মিলিয়ে একটা যা তা অবস্থা সবার। সত্যি কথা বলতে কী আমার নিজেরও। প্রতিক্রিয়া যেহেতু আমি খুব তাড়াতাড়ি দেখাতে পারি না, তাই সবাই বোধহয় ভাবে আমার কোনো ভয় নেই, বসের সাথে আমার দহরমমহরম চরমে! একদিন তো ফিরোজ সাহেব বলেই বসলেন হঠাৎ আরেহ তোমার কী চিন্তা বসের সাথে তো তোমার ভালোই খাতির আছে। এই হলো অবস্থা। কিন্তু বস আমাকে যে খুব একটা পছন্দ করে না সেটা আমি ভালোই জানি। বসকে যে আমি শুধু বসই মনে করি, সৃষ্টিকর্তা বা পালনকর্তা টাইপ কিছু না, এইটা তিনি বোধহয় বুঝতে পারেন। অভিজ্ঞতা আছে বুঝতে পারা যায়। তো এই কারণে আমার সাথে তেমন কোনো আলাপ করেন না। আমি যে এই অফিসে কাজ করি এটা মনে হয় তিনি ভুলে যান বা ভুলে থাকতে চান। 

আরও একটা জিনিস খেয়াল করেছি, আমার সাথে কোনোদিন কোনো শিক্ষকের ভালো সম্পর্ক  ছিলো না। সত্যি কথা হলো তারা আমাকে চিনে এই কথাও আমার মনে হয় না। শিক্ষকরা মনে হয় খুব বেয়াদব আর খুব ভালো ছাত্র ছাড়া কাউকেই খুব একটা মনে রাখে না। আমি এই দুইয়ের মধ্যে নাই। এভারেজ একটা জীবন যাপন করেছি চিরকাল। কেউ এজন্য চিনেও না জানেও না। বসের সাথেও এই সমস্যা। সমস্যা না, আমার সাথে এরকম পরিবেশ পরিস্থিতিই বোধহয় বেশী মানায়। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে আমার ভালো লাগবে না। যদিও সেটাও একটা যোগ্যতা। 

অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত হয়ে যাওয়ার পরেও নিজের মধ্যে আগ্রহ কাজ করে একটা জিনিসের প্রতি। রেশমির দিকে তাকিয়ে থাকতাম আগে। তখন তাকিয়ে থাকার উদ্দেশ্য ছিলো আলাদা। তখন রেশমি অন্য ব্যখ্যায় আমার সামনে হাজির ছিলো। রেশমির সাথে আমার বয়সের পার্থক্য দু’তিন বছরের। তাই তারও যথেষ্ট বয়স হয়েছে বলা যায়। রেশমির দিকে এখন তাকিয়ে থেকে দেখার চেষ্টা করি। না, দেখা না, বলতে হয় বোঝার চেষ্টা করি কিছু একটা। আর কী চাই আমি তার কাছে। শারীরিক সম্পর্ক চাইতাম অনেক বছর আগে। সত্যি কথা বলতে বেশী করে ওটাই চাইতাম আমি। পেয়ে যাওয়ার পর অনেক কিছু ভুলে যেতাম যেগুলো ছিলো গুরুত্বপূর্ণ । ওই আবেগ চলে গেছে কিছুকাল আগে। এই ‘কিছুকাল’ আরো কিছু সময় যাওয়ার পর বহুকাল হয়ে যাবে। এখন ভাবি রেশমির নামটা এখন আর শুনতে ভালো লাগছে না। রেশমি এমন একটা নাম যা বোধহয় বিশ থেকে ত্রিশ বছরের কোনো মেয়ের সাথে যায়। এর বেশি বয়স হয়ে গেলে এই নাম নিজের গুরুত্ব হারাবে তাই স্বাভাবিক। রেশমির সাথে আমার সম্পর্ক এখন দায়িত্বের মতো। দায়িত্বে যেহেতু আবেগ প্রায় চলে গেছে তাই এখন রেশমিকে যদি আমি বলি তোমার নামটা ঠিক আর তোমাকে মানাচ্ছে না তাহলে একটা যা তা অবস্থা তৈরী হবে। রেশমি তার বরিশালের ভাষার দক্ষতা দেখিয়ে দেবে আমাকে। যদিও তার বরিশালের ভাষা শুদ্ধ বা প্রমিত ভাষার মতো। যেমন আমার কুমিল্লার ভাষা এখন শুদ্ধ ভাষার মতো হয়ে গেছে। একেবারে যাকে বলে আঞ্চলিক ভাষা, এখন আমাদের মুখে পিউরিফাইড হয়ে প্রমিতের মতো শোনায়। তাই কিছু বলি না রেশমিকে। অযথা ঘাটানোর দরকার নাই। যেরকম আছে সেরকমই  থাকুক। 

ভাড়া বাসায় যে সমস্যা মোকাবেলা করতে হয় মানুষকে তেমন কোনো সমস্যা আজ অবধি মোকাবেলা করতে হয় নাই। বাড়িওয়ালা ভালো মানুষ। নামাজ কালাম পড়ার জন্য শুধু মসজিদে যখন যায় তখন  মাঝে মাঝে দেখা হয়। ছেলে দুটোর কথা জিজ্ঞেস করেন। মাঝে মাঝে দেখি তাদের সাথেও কথা বলেন। সবচেয়ে ভালো কথা ভাড়া দিতে তিন চারদিন দেরি হয়ে গেলেও কিছু বলেন  না। রীতিমতো অবিশ্বাস্য ব্যপার শহুরে কালচারের হিসেবে আরকি। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে বেশ। আশি তো হবেই। কিন্তু এখনো মোটামুটি ভালোই হাটতে পারেন। জীবনের অনেকটা সময় সৌদিতে ছিলেন। ভালোই পয়সা কামিয়েছেন বলা যায়। অনেক জায়গা জমি আছে। বেদখল হয়ে যাচ্ছে কিছু জমি এজন্য একটু চিন্তায় আছেন এমন কথাও বলছিলেন একদিন। বোঝা যায় এখনো ভালোই চিন্তা করেন এসব নিয়ে। তারো দুই ছেলে। তাদের বোধহয় তিনি খুব একটা ভরসা করতে পারেন না। স্বাভাবিক এটা বেশ কয়েকবছর বিদেশে থাকার ফলে যে দুরত্ব তৈরী হয়েছে মানসিকতার তার থেকে এমন সিদ্ধান্তে আসা অপ্রত্যাশীত না। 

যে এলাকায় থাকি তাকে আবাসিক এলাকা বলতে ইচ্ছে করে না। মহানগরে যেসব এলাকা গড়ে উঠছে বেশ কয়েকবছর ধরে সেগুলোর মধ্যে আধুনিক সুবিধা বলতে যা বোঝায় তার ছিটেফোঁটাও নাই। থাকার মধ্যে আছে শুধু অনেকগুলো বিল্ডিং যারে আবার ফ্ল্যাট কয় লোকে! সত্যি কথা হলো বস্তির সাথে এমন আবাসিক এলাকার খুব একটা পার্থক্য নাই। শুধু বস্তিতে যারা থাকে তারা এসব বাড়িতে কাজ করতে আসে। প্রভু আর মনিবের ছবি ভেসে উঠে এমন কথা বললে। এখন আবার দেখা যায় বাড়তি উৎসব চলে প্রভু আর মনিবের মধ্যে। ফেসবুকে ছবি দিয়ে মনিব প্রমাণ করতে চায় দাসী হওয়াটাও সম্মানের যদি মনিব আদর যত্ন করে তবে। আদর যত্নের ঠেলাঠেলিতে সবকিছুকে জাস্টিফাই করে দেওয়া আজকাল সহজ। ভালোবাসা বলে এসব কিছুকে চালিয়ে দেওয়া তো আরো বেশী সহজ। এসব কথা বলে লাভ নাই। সত্যি কথা বলতে লসও নাই তাই বলাই যায় যখন মন চায় তখন। আমার সাধ্য নাই বাসায় কাজের লোক রাখার কিন্তু মনে হচ্ছে রেশমির উপর আজকাল ভালোই ধকল যাচ্ছে। বয়স বেড়ে গেছে তার৷ কোমরে ব্যথাও প্রায় নিয়মিত। মাসে মুভ কিনতে হয় দুই তিনটা করে। দেশে এই ঔষধটা এখন ভালোই পাওয়া যায়। বিদেশে বানানোটাই পাওয়া যায়। বিদেশে রাশেদ থাকে আমার ছোট ভাই। একসময় ওরে বলা লাগতো আনার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এখন আর বলি না। বলা লাগেও না। কথাবলা কমে গেছে একদমই। মনে হয় দুইমাস আগে একবার বাড়ির কিছু জমির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে কথা বলার জন্য কল দিছিলো সে। নিজের জমি নিয়ে ঝামেলা না হলে রাশেদ ফোন দেওয়ার কথা না নিজ থেকে। 

সকালবেলা আগে খবরের কাগজ পড়ার শখ ছিলো। এখন আর তেমন একটা পড়ি না। তবুও কাগজ রাখি৷ আমার এখনো মনে হয় ঘরে খবরের কাগজ রাখাটা জরুরী কাজ। ছেলে দুইটা পড়ে। আমি জানি তারা দুইজনই খেলার পাতা ছাড়া অন্য কোনো খবর খুব একটা পড়ে না। মাঝে মাঝে হয়তো বিনোদনের পাতাও পড়ে। অবশ্যই লুকিয়ে। লুকানোর দরকার নাই যদিও আমার থেকে। আমার এসব ঠুনকো বিষয়ে ছেলেমেয়েদের বাধা দেওয়াটা ঠিক মনে হয় না। আমি নিজেও এই কাজ করেছি ঐ বয়সে। এখন যদি আমি আশা করি যে আমার ছেলেরা এসব করবেনা এই বয়সে তাহলে সেটা হবে মূর্খতার পরিচয়। ছেলেদের সাথে দুরত্ব বাড়ছে সেটা বুঝতে পারি। মা ঘেঁষা হয় ছেলেরা, আমার ধারনা। বাবার সাথে বয়স বাড়ার পরে খুব একটা সখ্যতা থাকে না আর অধিকাংশ ছেলেদের। আমার নিজেরও ছিলো না বাবার সাথে সখ্যতা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বেড়ে যায় দুরত্ব। আমার সাথেও আমার ছেলেদের দুরত্ব বেড়ে যাবে। সেটাই স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে মনে হয় একটা মেয়ে থাকলে ভালো হতো। তার সাথে এমন দুরত্ব থাকতো না কোনোদিনও। আমি নিজেকে চিনি তাই এই কথা হলফ করে বলতে পারি। পরক্ষনেই আবার মাথায় চিন্তা আসে নাহ তিনজন ছেলেমেয়ের সংসার চালানোর সামর্থ নাই আমার। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। 

আমি নিজে খবরের কাগজের খুব একটা বড় ভক্ত না আসলে। কিন্তু তবুও পড়ি। পড়তে মনে চায়। সম্পাদকীয় কলামে প্রায় দেখি তুমুল মত দেওয়া হচ্ছে। সমালোচনা হচ্ছে রাষ্ট্র, সাহিত্য, ইতিহাস সবকিছু একসাথে মিক্স করে। তুমুল ঝগড়া উসকে দিচ্ছেন সম্পাদক এমন একটা কিছু মনে করে প্রথম থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত গেলাম, কিন্তু না, শেষে দেখা গেলো কিছু চিরপরিচিত বাক্য যেমনঃ আমি আশা করছি আগের দেওয়া প্রতিশ্রুতি আমরা ভুলে যাবো না, আমরা নিশ্চয় বিচার পাবার আশা রাখি আজও, মানুষ আবার জেগে উঠবে, মানুষের উপর আশা হারানোটা ঠিক না, ইত্যাদি। অনেক আশা তাদের মনে। সাহিত্য পাতা উল্টানো হয় মাঝে মাঝে। কবিতা পড়া হয় বেশী।  গল্প ভালো লাগে না অধিকাংশ সময়। কবিতার অনেক কিছু হয়তো বুঝতে পারি না। কিন্তু কবিতায় নিজের মতো কোনো কিছু আবিষ্কার করার সুযোগ থাকে। গল্পে সেই সুযোগ থাকে না। যা বলে তাই সামনে উপস্থিত। আর তা দেখেই যাচাই করে নেয় পাঠকের মন যে এই লেখক কেমন লেখে। তবে আশার কথা অন্য ধরনের গল্পের চল নাকি শুরু হয়েছে। অনেকেই লিখছে। তাদের লেখা দেখি না পত্রিকায়। হলে গল্প সম্পর্কে মত আরো ভালো হতো আমার। 

ছোটোবেলায় একটা শখ ছিলো আমার। রাশিফল পড়ে ভালো লাগতো৷ এখনো পড়ি। বলতে দ্বিধা নাই যে আমার এখনো এই কাজ করতে ভালো লাগে। মানুষ কত সুন্দর সুন্দর আশা বা হতাশা দেখায়। সাবধান হতে বলে। আরো বলে সবকিছুতে পরিমিত ভাব বজায় রাখতে। মধ্যবিত্ত আচরণ করে রাশিফল যারা লেখে তারা। হয়তো এজন্যই বেশী কানেক্ট করি আমি রাশিফলের লেখার সাথে। ছোটোবেলায় যেসব বড়লোক বন্ধু পেয়েছি তাদের কোনোদিন বলতে শুনিনি এই কাজ করতে। বড় হয়েও কেউ এসব করার কথা বলেনি আমাকে। রাশিফলে বিশ্বাস করার কিছু নাই। বিশ্বাসের আলাপে রাশিফলকে বিচার করারও কিছু নাই। বিশ্বাসের আলাপ হলো আসলে একটা ফাঁদে পড়ে যাওয়ার পর যে আলাপের সুচনা হয় তার একটা উদাহরণ। পক্ষে থাকেন বা বিপক্ষে আপনি সেই ফাঁদে একবার পড়লে আর রক্ষা নাই।

অনেক কিছুরই অস্তিত্ব নাই হয়তো তবুও মনে হয় এই যে আমি আছি অনেকের মধ্যে, এটাও একটা খুশীর খবর। কিছু মানুষ আমার সাথে ওতোপ্রোতভাবে মিশে আছে তারা আমার উপস্থিতি অস্বীকার করছে না বা অস্বীকার করতে পারছে না এটাও একটা আনন্দের খবর। এই আনন্দের মাঝে ভালো লাগে। মাঝে মাঝে খারাপও লাগে।

লেখকঃ সিয়াম আল জাকি, লোক প্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়