ফিলিস্তিন প্রশ্ন

হাসিন সরকার মাহদি

প্রশ্নটা রেফারেন্স পয়েন্টের। ‘জেরুসালেম তুমি কার?’ — এই প্রশ্নের জবাব এত সোজা না। যে যেখান থেকে গুনবে তার কাছে জবাব সেরকম। ইতিহাস বেশিরভাগ সময়ই বিজয়ের কথা বলে, যা কিনা বিজয়ীর কলমে লেখা হয়, ন্যায়–অন্যায়ের কোন বালাই নাই এখানে।

পয়লা কথা হল, বর্তমান ইসরাইল–ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের বেশিরভাগ ইহুদিই প্রকৃত ইহুদি নয়, বেশিরভাগ আরবই প্রকৃত আরব নয়। এরা যথাক্রমে ইহুদায়িত ইহুদি (বেশিরভাগই এক–দুই–তিন পুরুষ আগে ইউরোপ থেকে আগত) এবং আরবায়িত আরব (এশিয়ান)। জেনেটিক পরীক্ষা চালালে এই সত্যই বেরিয়ে আসবে। ইসরাইলিরা শক্তিশালি বলে এই সত্য লুকিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় তারা মোটামুটি সফল, ফিলিস্তিনিরা ততটা নয়। 

এখন কথা হল, জেরুসালেম তথা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ন্যায়সঙ্গত মালিকানা কার? কেউ যদি আটচল্লিশ সালের ঘটনার দিকে তাকায় তাহলে তার পক্ষে এই রায় অনায়াসেই দেয়া সম্ভব— শান্তির শহরের মালিক ফিলিস্তিনিরা (মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান নির্বিশেষে), ইসরাইলিরা অবৈধ দখলদার।

এবার তাকানো যাক পিছনে। অষ্টাদশ আর ঊনবিংশ শতকে জেরুসালেমে ইহুদি বাড়তে থাকলেও আগে পরে গত দেড় হাজার বছর ধরে গোটা লেভান্ট কয়েক দফায় আরবায়ন তথা ইসলামায়নের মধ্য দিয়ে গেছে। মধ্যযুগের অটোমান আর মামলুকরা বহিরাগত ছিলো। এর আগে দ্বাদশ শতকে কুর্দি মিলিটারি জিনিয়াস সালাউদ্দিন ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের লেভান্টে পরাজিত করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুসলিমদের সম্ভাব্য বিলুপ্তির আশঙ্কার হাত থেকে রক্ষা করেন। এসব ক্ষেত্রে কারা বহিরাগত সে ব্যাপারে প্রাচ্য–প্রতীচ্য কারোরই দ্বিমত থাকবার কথা নয়।

এবার ফিরি আরো প্রায় ছয়শ’ বৎসর পিছনে। ইসলামের কন্সট্যান্টাইন বা অশোক যাই বলি না কেন, হজরত উমর বিন খাত্তাব তখন (638 AD) জেরুসালেম দখল করেন। ইসলাম বা আরব জাতির ইতিহাসে এই দখল ‘জয়’ হিসেবে লিখিত হবে। বাইজেন্টাইন লেভান্ট তখন মাল্টি এথনিক না হলেও অন্তত মাল্টি কালচারাল (সেই ঐতিহ্য এখনো কিছুটা নিভু নিভু প্রদীপে লেবাননের মাটিতে জ্বলছে, বাকিরা সবাই মোটামুটি আরব সাগরের মহাস্রোতে দেহমন সঁপেছে– জেনেটিক পরীক্ষা ছাড়া সেই তত্ত্বতালাশ এখন আর সম্ভব নয়)।

উমরের জেরুসালেম বিজয়ের সময় ঐ এলাকা প্রশাসনিক ভাবে রোমান, সাংস্কৃতিকভাবে হেলেনিস্টিক, রোমান আর সেমিটিক কালচারের একটা জগাখিচুড়ি। অত্র এলাকায় তখন আর খ্রিস্টপূর্ব যুগের পরিমাণে ইহুদি নেই। এমতাবস্থায় জেরুসালেম এক দখলদারের (বাইজেন্টাইন) এর হাত থেকে আরেক দখলদারের (আরব) হাতে হস্তগত হল। তৎকালীন ইহুদিরা এক্ষেত্রে পরাধীন দর্শক মাত্র।

এবার ফিরি আরো ছয়শ বছর পিছনে, প্রথম শতাব্দিতে। রোমানরা ইহুদিদের অতিরিক্ত ‘বেয়াদবি’ বরদাস্ত করতে না পেরে সত্তর–একাত্তর সনে তাদেরকে তাদের ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ (Promised Land) থেকে বিতাড়িত করে দেয়। ইহুদিরা হিজরত করে তখনি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে; পূর্বে চীন থেকে পশ্চিমে অতলান্তিক, উত্তরে রাশা থেকে দক্ষিণে মধ্য আফ্রিকা। যিশুর সৌভাগ্য যে তাঁকে স্বজাতির এই দুর্দশা দেখে যেতে হয় নি।

বিতাড়নের ঘটনা এই প্রথম নয়। পূর্বতন মেসোপটেমিয়ান দখলদাররা সবসময় ইহুদিদের প্রতি সদয় ছিল না। ‘ব্যবিলনের বন্দিদশা’ তো খুবই বিখ্যাত– যা কিনা ইহুদি ধর্মের বিবর্তনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এগুলো ওল্ড টেস্টামেন্টেই আছে, যার দোহাই পেড়ে ইসরাইলিরা নিজেদের জায়েজ করতে চায়।

এইবার আসি সবচেয়ে ট্রিকি পার্টে। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ বলছেন, আব্রাহাম যদি ঐতিহাসিক চরিত্র হন তাহলে তিনি যিশুর চেয়ে বয়সে দুই থেকে আড়াই হাজার বছরের বড় হবেন। তিনি যখন ‘হারান’ থেকে ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ ‘কেনানে’ (লেভান্টের পূর্বনাম) আসেন তখন সেখানে সেমিটিক অসেমিটিক হরেক জাত বেজাতের মানুষ বসত করত। বাইবেলেই বলা আছে আব্রাহাম একজন আরামীয় (ইরাকের ‘উরে’ জন্মানো একজন এসিরীয়, খুব সম্ভবত), তিনি কেনানের নেটিভ নন। নতুন দেশে আসা মাত্রই হিব্রু বা ইহুদি জাতি বলে কিছু গড়ে উঠেনি। সে অনেক পরের ঘটনা।

যিশুর জন্মের হাজার–বারোশ’ বছর আগে ইসরাইলি জাত বলে কিছু একটা দানা বেঁধে উঠতে থেকে। নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে তারা স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে আধিপত্যবাদের লড়াইয়ে লিপ্ত হয়; এ যেন তিন হাজার বছর পরের ফিলিস্তিন দখলের জন্য হাত মকশো করা। এসময় ইহুদিদের শত্রু কারা কারা ছিল তার সবিস্তার বিবরণ আছে বাইবেলে। তাদের বেশিরভাগই ছিল সেমিটিক জাতভাই, কিন্তু একদল অসেমিটিক লোকসমষ্টি আজ অব্দি এই আলোচনায় প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। তাদেরকে ইহুদিরা নাম দিয়েছিল— যেটা হয় আরকি– Philistines (Biblical Hebrew ‘Palishtim’ থেকে)। এই নামের মানে খুব সম্ভবত ‘বিদেশি’ বা ‘যাযাবর’।

Philistine রা ছিল অত্র এলাকার অন্যতম আদিবাসী যাদের প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিতরূপে জানা সম্ভব হয়নি (অনেকের মতে, তারা ফিনিশীয়দের কর্তৃক ক্রিট থেকে আনীত মারসেনারি সেনাদের বংশধর ছিল যারা মিশরীয়দের খুব প্যারায় ফেলে দিয়েছিল)। তো ইহুদিদের এই পরভূমি দখলের সাতকাহন জানতে কোন সেকুলার বইপুস্তকের প্রয়োজন পড়ে না। মহাভারত–রামায়ণ যেমন আমাদের প্রাচীন ভারতের অনেক খোঁজ দেয়, প্রাচীন ইহুদিদের কীর্তিকলাপ ঠিক তেমনি বাইবেলের পুরাতন নিয়মে (ওল্ড টেস্টামেন্ট) প্রাপ্য।

এখানে আমার কাছে কিছু জিনিস ইন্টারেস্টিং লাগে। যেমন ভারতীয় ঐতিহ্যের রাম–রাবণ মিথের মত ইহুদি ঐতিহ্যের ডেভিড–গোলিয়াথ মিথ। আপাত দুর্বল আর্য দেবতা রামের ভূমিপুত্র পরাক্রমশালী রাবণের বিরুদ্ধে জয়লাভের সাথে ডেভিড–গো্লিয়াথের সংঘর্ষের কাহিনী গুণগতভাবে একই। লঙ্কার অনার্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বহিরাগত জাত্যাভিমানী আর্যদের যে ঘৃণার খোঁজ পাওয়া যায় ঠিক সেই ঘৃণা ইহুদিরাও ফিলিস্টিনদের করতো– তারা তাদের সহিংস ও অসংস্কৃত (স্যাভেজ) বিবেচনা করত। এককথায়, ভারতীয় অভিজ্ঞতার কপি–পেস্ট।

যাইহোক, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে নেবুচাদনেজারের আক্রমণের সময় Philistine জাতটা দুনিয়ার বুক থেকে গায়েব হয়ে যায়। ইহুদিদের দেয়া নামটা গ্রিক হয়ে ল্যাটিনে এসে দাঁড়ায়– Palaestina। রোমানরা তাদের দখলকৃত দক্ষিণ লেভান্টের ইহুদি পরিচয় মুছে দিতে অত্র এলাকাকে প্যালেস্টিনা নাম দেয় (এই কারণে ইহুদিরা এই নামটি আরও বেশি অপছন্দ করতে থাকে)। বাইজেন্টাইনদের হাত থেকে লেভান্ট মুসলিমদের হাতে যাওয়ার পরে ব্রিটিশদের আগমনের আগ পর্যন্ত এই নাম বহুল পরিচিত ছিল না। এখানকার মুসলমানরা নিজেদের ‘আরব’ বা ‘দক্ষিণ সিরীয়’ বলে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। এমনকি ১৯২০ এ ব্রিটিশরা যখন ‘প্যালেস্টাইন’ নামটি অফিশিয়াল করে মুসলিমরা প্রাথমিকভাবে এ উদ্যোগকে সন্দেহের দৃষ্টিতেই দেখেছিল। কিন্তু ইসরাইলের প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার প্রক্রিয়ায় তারা নিজেদের ‘ফিলিস্তিনি’ পরিচয় তুলে ধরে।

এই হল মোটা দাগে গত তিন–চার হাজার বছরের ‘শান্তির শহর’ তথা ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’র কেচ্ছা। আরও পিছনে গেলেও এরকম দখলদারির প্রমাণই পাওয়া যাবে, অতএব প্রকৃত মালিকের সন্ধান করতে গেলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হওয়ার দশা হবে এখানে। নিঃসন্দেহে ফিলিস্তিনের সর্বপ্রথম অধিবাসীদের এখন খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।

বলা হয় ইয়াসির আরাফাত শেষ জীবনে এই কথাটাই অনুভব করেছিলেন, ফিলিস্তিন আসলে আরব বা ইহুদি কারোরই বাপ–দাদার সম্পত্তি নয়।

আমি ব্যক্তিগত অনুভবে এখনো টু স্টেট সলিউশনের ব্যাপারটাতে কমফোর্টেবল নই। কারণ আমার কাছে আটচল্লিশ পূর্ববর্তী ফিলিস্তিনের ডেমোগ্রাফি অধিকতর নর্মাল স্টেট মনে হয়। এভাবে দুই হাজার বছর আগেকার কারো সাথে নিজের ফেইক রিলেশন দেখিয়ে অন্য কারো ঘরবাড়ি দখল করে ফেলাটা শুধু অযৌক্তিকই নয়, হাস্যকরও বটে (তাহলে তো ইসরাইলের ধর্মপিতা আমেরিকা আর ধর্মমাতা ব্রিটেনকে যথাক্রমে কেল্ট আর ইন্ডিয়ানদের হাতে তুলে দিতে হয়)। দুনিয়ার ইতিহাসে এহেন সোলেমানি কাণ্ড আর কখনো ঘটে নি। জায়নিস্টরা যে ব্রহ্মাস্ত্রটি (আক্ষরিক অর্থে) ছুঁড়ে তা হল বেদবাক্য, থুক্কু বাইবেলবাক্য— “This land was promised to us by God himself”। এই বাইবেলের পুরাতন নিয়ম (ওল্ড টেস্টামেন্ট) দুনিয়ার কয়েক কোটি ইহুদি বাদে আর কেউ বিশ্বাস করে না (সব ইহুদি আবার এক ব্যাখ্যাতেও আস্থাশীল নয়)। অতএব এই যুক্তি একটি প্রথম শ্রেণীর শৈল্পিক ফাজলামি ছাড়া আর কিছুই নয়; একথা বলা যেতেই পারে যে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাতাদের কারোরই এ তত্ত্বে ইমান ছিল না। সৎ হলে ইসরাইলকে একথা বলতে হবে যে, সে উগ্র নগ্ন জাতীয়তাবাদি কারণে বলপ্রয়োগে প্রতিষ্ঠিত, ঠিক যেমনটি ছিল ভারতে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব।

প্রথম শতাব্দির মত কেউ এসে যদি উচিত শাস্তি ও শিক্ষা দিয়ে সব ইসরাইলিকে (যারা আদতে ইহুদি না) বের করে দিত-খুব ভাল্লাগত।

আর যাদের কাছে মনে হয় বর্তমান ডেমোগ্রাফিটাই নরমাল তাদের কাছে টু স্টেট সলিউশন জাস্টিফাইড লাগতেই পারে।

লেখকঃ হাসিন সরকার মাহদি, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।