জায়নবাদী গনহত্যার প্রতি পাশ্চাত্যের সমর্থনের আদর্শিক ভিত্তি

মাহদী মাহমুদ

জায়নবাদী ইহুদিরা ফিলিস্তিনের মাটিতে প্রথম সন্ত্রাসবাদী অভিযান চালায় ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে। এ সময় ইউরোপ থেকে আগত জায়নবাদী সস্ত্রাসীরা ফিলিস্তিনের ‘উয়ূন কারেহ’, ‘মাল্বাস’ ও ‘জামারিন’ নামক তিনটি গ্রামের ওপর হামলা চালিয়ে অনেক অধিবাসীকে হত্যা করে এবং বাকিদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে গ্রাম তিনটি দখল করে নেয়। ১৯৪৮ সালের ৯ এপ্রিল মেনাহেম বেগিন ও আইযাক শামীরের নেতৃত্বে ১৩০ জন যায়নবাদী সন্ত্রাসী বায়তুল মুকাদ্দাসের অদূরবর্তী পার্বত্য পল্লী ‘দার ইয়াসীনের’ নিরীহ ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা গ্রামটির চারশ’ অধিবাসীর মধ্যে নারী–পুরুষ, শিশু–বৃদ্ধ, সুস্থ–অসুস্থ নির্বিশেষে ২৫০ জনকে হত্যা করে। তাদের পৈশাচিকতা শুধু হত্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি; বরং তারা হত্যার জন্য অত্যন্ত বীভৎস পন্থা অবলম্বন করে। তারা আনেকের হাত পা, পেট ও কান কেটে ফেলে, চোখ তুলে নেয়, মাথার খুলি চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলে, নারীদের পেট কেটে দেয়, মায়ের কোলে সন্তানকে হত্যা করে, অনেককে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে। এছাড়া কতক ফিলিস্তিনী তরুণীকে নগ্ন করে ট্রাকে তুলে বায়তুল মুকাদ্দাসের ইহুদি এলাকায় নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়ে লোকদেরকে প্রদর্শন করে এবং ঐ অবস্থায় তাদের ছবি তুলে রাখে। ১৯৮২ সালে তারা যখন লেবানন দখল করে তখন পঁচিশ হাজার লোককে হত্যা করে, দুই লাখ আশি হাজার জনকে আহত করে এবং দুই হাজার কোটি ডলার মূল্যের সম্পদ ধ্বংস করে (Jerusalem, El-Menzahvi, Tunisia, May 1985, P. 19) ।

আর চলমান গাজা গনহত্যায় এখন অবধি (১৪–১১–২০২৩) প্রায়  ১২,০০০ মানুষ নিহত হয়েছে, যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই শিশু ও নারী।  একইসাথে প্রস্তাব দিয়েছে ফিলিস্তিনিদের জন্যে জর্ডান এবং মিশরে আশ্রয় শিবির তৈরির। এভাবে তারা লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করে শরণার্থী বানানোর নীল নকশা এঁকেছে। শুধু কি তাই? গাজার ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রন এবং প্রশাসনিক কাজের জন্যে অবৈধ ইজরায়েল সরকারকে নিয়োগের সুষ্পষ্ট ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছে। গণহত্যা, যৌন নিপিড়ন, বাস্তুহরন, অভিবাসনে বাধ্য করা, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রন এরকম আগ্রাসী ও অমানবিক সকল পন্থার আশ্রয় নিয়েছে অবৈধ রাষ্ট্র ইজরায়েল।    

জায়নবাদী শাসকগোষ্ঠী দ্বারা সংঘটিত অপরাধ সমূহ বর্ণনা করার জন্য সর্বাধিক ব্যবহৃত অভিব্যক্তি (শব্দবন্ধ) গুলোর একটি হল গাজার বেসামরিক নাগরিকদের উপর সংঘটিত “কালেক্টিভ পানিশমেন্ট” বা সামষ্টিক শাস্তি, যেটাকে “গাজা জেনোসাইড” বা গাজা গণহত্যা বলা হচ্ছে।  কালেক্টিভ পানিশমেন্টের বিষয়টি  আন্তর্জাতিক আইনের জেনেভা কনভেনশানের ৩৩ তম অনুচ্ছেদ এবং এডিশনাল প্রোটোকল ২ অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। তথাপি এই গনহত্যার প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, কানাডা, জার্মানি এবং ফ্রান্সের পূর্ণ সমর্থনের কারনে এই শাসকগোষ্ঠীসমুহ বিশ্ব জনমতের তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়েছে। সারা বিশ্বের মানুষের মনে যে প্রশ্ন জেগেছে তা হল: যে দেশগুলি উদারনৈতিক গণতন্ত্রের (লিবারেল ডেমোক্রেসি) ধারক–বাহক তারা কেন এই ভয়নক অপরাধকে শুধু প্রশ্রয়ই দিচ্ছে না বরং  সক্রিয়ভাবে পরিচালনাও করছে?

পাশ্চাত্যের লিবারেলিজমের সবচেয়ে মারাত্মক ত্রুটি হল যে এটি “ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ” (ইন্ডিভিজুয়ালিজম) কে কেন্দ্র করে আবর্তন করে এবং “নীতি–নৈতিকতা” এ মতবাদে সার্বিক ও কেন্দ্রীয় কোন অবস্থান লাভ করেনি। যখন আমরা লিবারেলিজমের অন্যান্য উপাদানগুলির কথা বলি, যেমন সাম্য, যুক্তিভিত্তিক সিদ্ধান্তনীতি, অধিকার, ব্যক্তিমালিকানা এবং স্বাধীনতা, সেগুলি সবই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের সাথে সম্পর্কিত। মানবীয় মূল্যবোধ, যা মানব সমাজে মানবিক সম্পর্কের মাপকাঠি হিসাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বাইরে রাখা উচিত, উদারতাবাদে এরও স্থান নেই। এটি সমাজের উপর মানবিক শাসনের অনুপস্থিতির সমতুল্য। এই ধরনের সমাজেই আমরা বর্ণবাদ এবং সামাজিক ডারউইনবাদের তাত্ত্বিক কাঠামোর উত্থান অবলোকন করি। অন্যভাবে বলতে গেলে, পরোক্ষাভবে পাশ্চাত্যের প্রচলিত লিবারেলিজমের কথা এমনই যেন,  শুধুমাত্র শক্তিশালী সমাজেরই টিকে থাকার অধিকার রয়েছে এবং দুর্বলেরা স্বাভাবিকভাবেই নির্মূল হবে।

উদারপন্থী দেশগুলির শত শত বছরের ঔপনিবেশিকতা লিবারেলিজমের নীতি অনুসারে সবচেয়ে অযৌক্তিক আচরণ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু যখন আমরা মনোযোগের সাথে দেখি, তখন আমরা উদার সাম্রাজ্যবাদ নামক একটি বিষয়বস্তুর সম্মুখীন হই। এই তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি হল “ঐতিহাসিক উন্নয়নের পর্যায়” এবং “উদারনীতির” তত্ত্বের সংমিশ্রণ।

ঐতিহাসিক উন্নয়নের পর্যায়” তত্ত্ব অনুসারে, সমস্ত সমাজ স্বাভাবিকভাবেই পশুশিকার থেকে শুরু করে পশুপালন, কৃষি, বাণিজ্য পর্যন্ত একটি ক্রমন্নোয়নমূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়, যা একই সাথে “সম্পূর্ন অসভ্যতা (savagery)” থেকে “বর্বরতা (Barbarism)” হয়ে “সভ্যতা (civilization)” পর্যন্ত একটি সাংস্কৃতিক ক্রমধারা গঠন করে। এই তত্ত্বে, সূর্য যেভাবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে, তেমনি সভ্যতাকে সর্বদা পশ্চিমে আরও বিকশিতরূপে পাওয়া যায়। জন স্টুয়ার্ট মিল, যাকে উদারনীতির অন্যতম জনক বলে মনে করা হয়, তার মতো লেখকের রচনায় ‘সভ্যতা’, ‘বর্বরতা’ এবং ‘সম্পূর্ন অসভ্যতা’ ইত্যাদি পরিভাষা প্রচলিত। এই ‘ঐতিহাসিক উন্নয়নের পর্যায়’ শীর্ষক তত্ত্বটি উদারনৈতিক ঐতিহ্য থেকে আলাদা নয় এবং, অ্যাডাম ফার্গুসন এবং অ্যাডাম স্মিথের মতো ব্যক্তিবর্গ এর (ঐতিহাসিক উন্নয়নের পর্যায়) প্রধানতম প্রবক্তাদের মধ্যে ছিলেন বলে বিবেচনা করা হয়, যারা একইসাথে লিবারেলিজমের পুরোধা ব্যক্তি ।

সভ্যতা একটি ঐতিহাসিক বিকাশ প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পরিণতি— এই ধারণাই সাম্রাজ্যবাদকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। যদিও উদারনৈতিকতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলির মধ্যে একটি এই সত্যের উপর ভিত্তি করে যে– সমস্ত মানুষেরই যুক্তিবাদীতার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌছার সক্ষমতা এবং সার্বভৌমত্ব লাভের অধিকার রয়েছে, কিন্তু ‘ঐতিহাসিক বিকাশের পর্যায়’ তত্ত্ব এই সার্বজনীনতাকে সভ্যতার একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে যাওয়ার পরে কার্যকর বলে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। অন্যভাবে বললে, তারা বলতে চায়, মানুষ ‘সভ্য’ না হলে উদার অবস্থার (স্বাধীনতা এবং সমান অধিকার) অধীনে বেঁচে থাকার সক্ষমতা রাখে না।

উদাহরণস্বরূপ, জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, ঐতিহাসিক বিকাশের পর্যায়ে, সম্পূর্ণ অসভ্য (savage) গোত্র বা সমাজসমূহে স্বাধীনতার প্রতি অত্যধিক ভালবাসার কারণে তারা সমাজ পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখেনা। অন্যদিকে, বর্বর (Barbarian) সমাজে প্রজা, দাস এবং কৃষকদের মধ্যে আনুগত্য এতটাই অভ্যন্তরীণভাবে তৈরি করা হয়েছে যার ফলে তাদের মধ্যে যুক্তিবাদীতার ক্ষমতা দমে গিয়েছে। এটি কেবলমাত্র “বাণিজ্যিক সমাজ/ পূজিবাদী সমাজ”, যার পক্ষে সম্ভব এমন বস্তুগত এবং সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি তৈরি করা, যা মানুষকে তাদের স্বাধীনতা এবং স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা ও সীমানা উপলব্ধি করাতে সক্ষম করে।

এই যুক্তি অনুসারে, ইংল্যান্ডের মতো সভ্য সমাজ স্বল্পোন্নত ও অপেক্ষাকৃত “কমসভ্য” মানুষকে শাসন করে, এদের পক্ষে অনুগ্রহবশত। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, সাম্রাজ্যবাদ মূলত রাজনৈতিক আধিপত্য এবং অর্থনৈতিক শোষণের একটি রূপ নয়, বরং “উন্নত রাষ্ট্র” সমুহের অভিভাবকসুলভ আচরন যা এইসব অসভ্য ও বর্বর ভুমির আদিবাসীদেরকে ঐতিহাসিকভাবে অগ্রসর হতে সাহায্য করার নিয়তে “সভ্যতা” (উদাহরণস্বরূপ, আধুনিকায়ন) রপ্তানি করে ঠিক যেভাবে সন্তানকে সভ্য বানানোর জন্যে দায়িত্বশীল পিতা জোর পিটুনি দিয়ে থাকে। স্বৈরতন্ত্র (এ শব্দ জন স্টুয়ার্ট মিল তার রচনায় উল্লেখ করতে সংকোচ করেননি) উন্নতির একটি উপায় যা এইসকল হতভাগা সমাজকে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব সরকার গঠনের উপযোগী করে তোলে।  এই তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে “The White Man’s Burden” হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে – আর তা দুর্ভাগ্যবশত উপনিবেশের অধীনে থাকা সমাজের কিছু বুদ্ধিজীবী দ্বারা গৃহীত হয়েছিল।

যেভাবে আমাদের এই ধরনের চিন্তাধারার মাধ্যমে উপনিবেশবাদকে লিবারেলিজমের ফল হিসেবে বিবেচনা করা “উচিত”, একইভাবে বলা যায় যে, জায়নবাদী ইজরায়েলের হাতে গাজার জনগনের উপর চলমান গনহত্যার প্রতি লিবারেল রাষ্ট্রসমুহের শাসকগোষ্ঠীর লজ্জাজনক সমর্থন লিবারেলিজমের নীতি–দর্শনেরই ফলাফল। ঔপনিবেশিকতায় যেমন ঔপনিবেশবাদ বিরোধী বিদ্রোহ দমনের কোনো নৈতিক বা মানবিক সীমাবদ্ধতা ছিল না, তেমনি বর্ণবাদী ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামী গাজাবাসীদের নির্দয়ভাবে কচুঁকাটা করার পথেও কোন নৈতিক ও মানবিক সীমাবদ্ধতা পাশ্চাত্য অনুভব করছেনা। আর এভাবেই এই উড়ে এসে জুড়ে বসা রিফ্যুজিদের অবৈধ শাসকেরা, জয়তুনগাছের মালিক ফালাস্তিনিদের ​প্রতিরোধকে নতজানু করার আশায় গাজাবাসীদের প্রতি সম্মিলিত শাস্তির নীতি অনুসরন করে চলেছে!

লেখকঃ মাহদী মাহমুদ, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষক, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিয়োগ্রাফিক ইনফরমেশান সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)