কারাপ্রকোষ্ঠ
মাহমুদ দারবিশ (১৯৪১–২০০৮)
এটা সম্ভব…
অন্তত কখনো কখনো…
এটা সম্ভব, বিশেষ করে এই মুহূর্তে
এই কারাপ্রকোষ্ঠের ভেতরেই
একটা ঘোড়ায় চড়া,
এবং পালিয়ে যাওয়া…
এটা সম্ভব, যে গায়েব হয়ে যাবে
কয়েদখানার দেয়ালগুলো
আর সীমান্তহীন এক ভূ-খণ্ডে পরিণত হবে
এই কারাপ্রকোষ্ঠঃ
দেয়ালগুলোর কী করেছিলে তুমি?
পাহাড়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছি।
কী বন্দোবস্ত করেছিলে ছাদের?
ওটাকে বানিয়েছিলাম ঘোড়ার জিন।
আর তোমার শেকল?
ওটাকে বদলে ফেলেছিলাম তুলিতে।
ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো কারারক্ষী,
আর থামিয়ে দিলো আমার সংলাপ।
কবিতার ধারও ধারে না সে, বললো
আর বন্ধ করে দিলো প্রকোষ্ঠের দরজা।
পরদিন সকালে
আবারো আমাকে দেখতে এলো সে
আর চিৎকার জুড়ে দিলো:
কোত্থেকে এলো এতো এতো পানি?
নীলনদ থেকে এসব বয়ে এনেছি আমি।
আর এই গাছগুলো?
দামেস্কের বাগান থেকে।
আর এই সঙ্গীত?
আমার হৃদস্পন্দন থেকে।
উন্মাদ হয়ে গেলো কারারক্ষী,
আর থামিয়ে দিলো আমার সংলাপ।
আমার কবিতা সে পছন্দ করেনি, জানালো
আর বন্ধ করে দিলো প্রকোষ্ঠের দরজা।
কিন্তু সন্ধ্যায় আবারো ফিরে এলো সেঃ
কোথা হতে এলো এই চাঁদ?
বাগদাদের রজনী থেকে।
আর এই সুরা?
আলজিয়ার্সের আঙুরকুঞ্জ থেকে।
আর এই স্বাধীনতা?
গত রাতে আমাকে যে শেকল পরিয়েছ
তার থেকে।
বিষাদে মুষড়ে পড়লো কারারক্ষী…
আর মিনতি করতে থাকলো আমার কাছে
তার স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে।
~~~
জেরুজালেম
নিজার কাব্বানি (১৯২৩–১৯৯৮)
চোখের জল শুকিয়ে আসা অব্দি কেঁদেছি আমি,
প্রার্থনা করেছি মোমের আলো নিভে যাওয়ার আগ পর্যন্ত,
রুকুতে ছিলাম যতোক্ষণ না রুকু নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে
সওয়াল করেছি মোহাম্মদ আর ইসার ব্যাপারে
ও জেরুজালেম, পয়গম্বরদের সুবাসে মোড়া
আরশ আর জমিনের সংক্ষিপ্ততম পথ
ও জেরুজালেম, বিধিবিধানের তীর্থ
আনত চোখ আর দগ্ধ আঙুলের সৌম্যকান্তি শিশু
তুমিই সেই ছায়াচ্ছন্ন মরুদ্যান
যার ছায়ায় হেঁটে গেছেন নবী,
বিষাদে ছাওয়া তোমার সমস্ত পথ,
রোনাজারি করছে তোমার সকল মিনার।
ও জেরুজালেম, শোকের পোষাকে আবৃতা
কে বাজাবে পুনরুত্থান দিনের ঘণ্টি?
ক্রিসমাসের সন্ধ্যায়
শিশুদের জন্য বয়ে আনবে উপহার?
ও জেরুজালেম, দুঃখের নগরী,
কান্নায় ছলছল চোখ,
কে থামাবে তোমার ওপরে চলা
এই জুলুম, ও ধর্ম–চূড়ামণি?
কে মুছে দেবে তোমার রক্তাক্ত দেয়াল?
সুরক্ষা দেবে ইঞ্জিলের
আর উদ্ধার করবে কোরান?
যিশুকে যারা হত্যা করেছে
তাদের হাত থেকে কে বাঁচাবে যিশুকে?
কেই–বা বাঁচাবে ইনসানকে?
ও জেরুজালেম, নগরী আমার
ও জেরুজালেম, প্রেয়সী আমার
আগামীকাল ফুলে ফুলে ছেয়ে উঠবে লেবুগাছগুলো,
আনন্দে মাতোয়ারা হবে যয়তুনের গাছ,
নেচে উঠবে তোমার চোখ,
ফিরে আসবে মোহাজির যতো কবুতর–
তোমার পবিত্র ছাউনিতে,
আর আবারো খেলায় মাতবে তোমার শিশুরা,
গোলাপশোভিত পাহাড়ে পাহাড়ে–
পিতা আর পুত্রের পুনর্মিলন হবে,
ও দেশ আমার,
ও শান্তি আর যয়তুনের দেশ।
(*নিজার কাব্বানি সিরিয়ার জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃত)
~~~
পদচ্ছাপ
মুইন বাসিসু (১৯২৬–১৯৮৪)
ভাই আমার!
আমার ঘাড়েও যদি ওরা তরবারি শান দেয়,
হাঁটু মুড়ে বসবো না আমি;
আমার রক্তাক্ত মুখের ওপর
ওদের চাবুকের আঘাতেও না,
ভোর যদি এতোটাই নিকটবর্তী
পিছু হটবো না আমি;
আমাদের প্রচণ্ড ঝড়গুলোকে
পরিপুষ্ট করে যে ভূমি
জেগে উঠবো সেখান থেকে।
ভাই আমার!
তোমাকে হাঁটু মুড়ে বসাবে বলে
জল্লাদ যদি তোমার চোখের সামনেও
আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় কসাইখানায়,
যাতে তুমি করুণা ভিক্ষা চাও;
আমি আবারো বলছি, দাঁড়াও মাথা উঁচু করে
আর দেখো আমাকে কতলের দৃশ্য!
দেখো জল্লাদকে,
আর আমারই রক্তে ভেজা তরবারি!
আমাদের নির্দোষ রক্ত ছাড়া
কী আর দেখাবে সেই খুনী?
রাত্রিবেলা বন্দুকের মুখে
ওর পরিখা থেকে
ওকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ওরা,
তারপর কারাপ্রকোষ্ঠের অন্ধকারে
নিক্ষেপ করা হয়েছিল সেই নায়ককে,
সেখানে শেকল ছাড়িয়ে
সে ছিল এক উড্ডীন নিশানের মতো।
শেকল হয়ে উঠেছিল জ্বলন্ত মশাল,
আর জ্বালিয়ে দিয়েছিল
আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে যা কিছু করেছে আড়াল।
আর আজও বেঁচে আছে সেই নায়ক,
আজও কয়েদখানার রুদ্ধ প্রকোষ্ঠের দেয়ালে দেয়ালে
শোনা যায় তার বিজয়ী পদধ্বনি।
~~~
কোনো সমস্যা নেই আমার
মুরিদ বারগুতি (১৯৪৪–২০২১)
তাকালাম নিজের দিকেঃ
কোনোই সমস্যা নেই আমার।
একদম ঠিকঠাক আছি,
আমার ধূসর চুল আকর্ষণীয়ই মনে হবে
কিছু কিছু মেয়ের কাছে;
সুন্দর করে বানানো আমার চশমা,
শরীরের তাপমাত্রা একদম ৩৭,
ইস্ত্রী করা শার্ট
আর জুতাজোড়াও আরামদায়ক।
কোনোই সমস্যা নেই আমার।
হাতে নেই হাতকড়া,
এখনও জবান বন্ধ করে দেয়া হয়নি,
এমনকি কারাগারেও যেতে হয়নি আমাকে,
ছাটাই করা হয়নি কাজ থেকে,
কয়েদখানায় আত্মীয়-স্বজনদেরও দেখতে যেতে পারি,
নানান দেশে তাদের কবর জিয়ারতেও
যেতে দেয়া হয় আমাকে।
কোনোই সমস্যা নেই আমার।
বন্ধুর মাথায় শিঙ গজিয়েছে
তা নিয়ে মোটেও বিচলিত নই আমি,
পোশাকের তলায় তার
লেজ লুকিয়ে রাখার চাতুরি পছন্দ আমার,
পছন্দ তার শান্ত থাবাও,
আমাকে খুনও করতে পারে সে,
কিন্তু বন্ধুত্বের খাতিরে
তাকে ক্ষমা করে দেবো আমি;
যে কোনো সময়
আমাকে আঘাত করতে পারে সে।
কোনোই সমস্যা নেই আমার।
টিভিতে উপস্থাপকের হাসিতে
মোটেও আর অসুস্থ বোধ করি না আমি,
খাঁকি’রা আমার স্বপ্ন, রাত আর দিন রুদ্ধ করে দেয়
তাও সয়ে গেছে।
সে কারণেই সবসময় পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখি,
এমনকি সুইমিং পুলেও।
কোনোই সমস্যা নেই আমার।
গতকাল রাতের ট্রেনে চড়ে বসে আমার স্বপ্নেরা
আর আমি বুঝেই উঠিনি
কী করে তাদের বিদায় জানাতে হয়।
শুনলাম, এক ঊষর উপত্যকায়
বিধ্বস্ত হয়েছে সে ট্রেন
(কেবলমাত্র ট্রেনের চালক বেঁচে গেছে)।
খোদাকে শুকরিয়া জানালাম আমি,
আর ব্যাপারটাকে সহজ করে নিলাম,
যেহেতু ছোটখাটো দুঃস্বপ্ন হয় আমার,
আশা করি এগুলোই একদিন
দুর্দান্ত এক স্বপ্নের জন্ম দেবে।
কোনোই সমস্যা নেই আমার।
জন্মের প্রথম দিন থেকে আজ অব্দি
নিজের দিকে তাকিয়ে আছি আমি,
নিরাশার কালে শুধু মনে রাখি–
মৃত্যুর পরেও এক জীবন আছে;
ফলে কোনোই সমস্যা নেই আমার।
কিন্তু প্রশ্ন রাখি:
হে খোদা,
মৃত্যুর আগে কী কোনোই জীবন নেই?
~~~
বদলা
তাহা মুহাম্মদ আলী (১৯৩১–২০১১)
সময় সময়
মনে হয়
যে মানুষটি হত্যা করেছে আমার বাবাকে,
আর গুড়িয়ে দিয়েছে আমাদের বসতি–ভিটা,
খণ্ডিত এক ভূ–খণ্ডের দিকে ঠেলে দিয়েছে আমাকে,
তার সাথে যদি লড়াইয়ে নামতে পারতাম।
যদি সে হত্যা করতো আমাকে,
শেষমেশ বিশ্রামে যেতে পারতাম আমি,
আর যদি সুযোগ আসতো আমার,
আমি বদলা নিতাম!
কিন্তু সেই শত্রু লড়াইয়ে নামার কালে
যদি জানা যেতো—
তার একজন মা রয়েছে,
যে কিনা অপেক্ষা করছে তার জন্য,
বা একজন বাবা,
ছেলের আসতে
কিছুটা দেরির কারণে
বুকের বাম পাশটায় চেপে ধরে যে,
তাহলে তাকে হত্যা করতাম না আমি,
সুযোগ থাকলেও না।
একইভাবে…
তাকে হত্যা করতাম না আমি
যদি জানতাম কোনো ভাই বা বোন আছে তার
যারা তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে,
আর অপেক্ষা করে সারাটা সময়
তাকে একনজর দেখবার জন্য,
কিংবা যদি থাকে স্ত্রী
তাকে স্বাগত জানাতে,
বা সন্তান,
যারা এক মুহূর্তও সইতে পারে না তার অনুপস্থিতি,
বাবার আনা খেলনা পেলেই লাফিয়ে ওঠে আনন্দে,
অথবা যদি তার বন্ধু কিংবা সঙ্গী থাকে,
চেনাজানা প্রতিবেশী,
কারাগার বা হাসপাতালের ইয়ার–দোস্ত
বা স্কুলের সহপাঠী…
যারা তার কুশল জানতে চায়,
তাকে পাঠায় সম্ভাষণ।
কিন্তু যদি দেখা যায় নিঃসঙ্গ সে,
গাছ থেকে ছেঁটে ফেলা বিচ্ছিন্ন একটা ডালের মতো,
যার না আছে মা, না আছে বাবা,
না আছে ভাই কিংবা বোন,
নেই স্ত্রী, নেই সন্তান,
আত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব কিছুই নেই,
তাহলে তার সেই নিঃসঙ্গতায়
নতুন করে আর কোনো যন্ত্রণাই
ঢালতাম না আমি,
মৃত্যুযন্ত্রণাও না।
বরং পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়
তার দিকে ফিরেও না তাকানোতে
সন্তুষ্টি খুঁজে নিতাম;
কেননা আমি জানি,
তার প্রতি বিন্দুমাত্র মনোযোগ না দেয়াই
এক কঠিনতম প্রতিশোধ।
~~~
তরজমাঃ হিজল জোবায়ের। কবি ও গদ্যকার। জন্মঃ ৩ মে, দিনাজপুর। পড়াশোনাঃ ফার্মাসি বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থঃ আদিম পুস্তকে এইরূপ লেখা হয়েছিল (২০১৫), ধুলা পবনের দেশ (২০১৮) ও জলপাই পাতার নিশান (২০২২)। সম্পাদনা: ওয়েবম্যাগ ‘নকটার্ন’ (যৌথ)।