শুক্রবারের বৃষ্টিতে বাবার সাথে বাজারে ঘোরার দিনগুলোই বেশি মনে পড়ে
আমার। সব শুক্রবারে বৃষ্টি না হলেও মাছ-বাজারের কাদামাটিতেই মিশে
গেছে শুক্রবার আর বৃষ্টি। বাবার সাথে বাজার ঘোরার দিন আমার শেষ হয়েছে
বহুকাল। তার হাতের বাজারের ব্যাগের ভারে নুইয়ে যাই না আর আমি। এখন
সময় ভিন্ন। বড় বড় রুই-কাতলা আর ইলিশের ভার দখল করে নিয়েছে কাঁচকি
মাছের মোড়ানো পলিথিন ব্যাগ, এই ভারেই মাটির সাথে মিশে যাওয়ার সময়
এখন। বাজার ঘোরার দিন শেষ তবু সেদিন সন্ধ্যার নিস্তেজ হয়ে আসা আলোয়
রেলক্রসিং পার হতে হতে দেখি বাবা অফিস শেষে ছোট ছোট পুটলি দিয়ে
খালি হয়ে আসা হাত ভরছে। আমরা মাছ-বাজারে নিয়ে আসি পুরনো শুক্রবার,
মাছের আঁশটে গন্ধ বাবাকে যেন পাগল করে দেয় মেছো বিড়ালের মুচড়ে ওঠা
ক্ষিধের মত। বাবা ভার বইতে চায় রুই-কাতলা-ইলিশের। অতো ভার বইবার
সময় আর কই? আমাদের ভারে নুইয়ে পড়া বাবা পলিথিন ভরে কাঁচকি মাছের
আঁশটে গন্ধে। দুজনে বাজার থেকে ফিরতে ফিরতে দেখি বাবা বাড়ি ফিরতে
ভুলে যায়। মাছের গন্ধ তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ত্রিশ/চল্লিশ বছর আগের সেই
তুমুল বর্ষায়— বাঁধানো ঘাটের সিড়িতে দৌড়ে এসে পড়লে পুঁটিগুলো ভয়ে বা
উৎসবে রূপালী আলোর ঝলকানি ফেলে সমুদ্র বিজয়ের প্রসন্নতাকে তুচ্ছ করে
এক পুকুর পাড়ি দিতো, অথবা সেই দুপুরে, যখন ধরাকে সরা জ্ঞান করার বয়স,
যখন পিঠে জ্বালা ধরানো রোদ্রের তাপকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বঁড়শিতে বৈচা-
খৈলশা ভরে শোল ধরার উৎসব। অথবা পূর্বপুরুষের সেই মোক্ষম অস্ত্র হাতে
কাদায় হাতড়ে বেড়ানো শিং, গজার। আমি দেখি মাছের রূপালী চোখের মত
চকচক করে বাবার ঘোলাটে চোখ, ডাঙায় ফেলে দেওয়া কইয়ের মত বাবার
বর্ষীয়ান হৃদয় ছটফট করে— আমি হাঁটতে হাঁটতে দেখি বাবা কি করে মাছ হয়ে
যায়, আমি দেখি বাবার হাতভর্তি রুই-কাতলা-ইলিশ-শোল কেড়ে নিয়ে আমরা
ভাই-বোনেরা একে একে ঝুলে পড়ি বাবার হাতে। বাবা আমাদের ভারে নুইয়ে
পড়ে, হাতে ধরে রাখা কাঁচকি মাছের মোড়কও আলগা হয়ে যেতে থাকে।
কাঁচকি মাছেরা একে একে লাফিয়ে পড়তে থাকে রাস্তায়। বাবা প্রাণপণ চেষ্টা
করে পুটলিটা শক্ত করে ধরে রাখতে। বাবার বর্ষীয়ান হৃদয় কইয়ের মত ছটফট
করে কপট গাম্ভীর্যে।
- শিক্ষার্থী, পপুলেশন সাইন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়