মোরগ ডাকছে। প্রবল শীত, সায়রা বেগম কাথাটা আরো ভালো করে জড়িয়ে নেয়। মোটা কাথাটা ধুতে দিয়েছে। এখনো শুকায় নি। পাতলা কাথায় শীত মানে না। পাশে তার দুই ছেলে আলাল-দুলাল আর মেয়ে রমিলা শোয়া। বড় ছেলে জালাল আলাদা শুয়েছে পাশের চৌকিতে। জালালের গায়ে মোটা কাথা, সায়রা বেগমের মনে হল, তবুও ছেলেটার শীত লাগছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ছেলের বাপ কই চষে বেড়ায় সে জানে না। শুনেছে শহরে লেপ পাওয়া যায় কমদামে। অনেকবার বলেছে আনার জন্য, তার স্বামী মইজুদ্দীনের ওইদিকে কোনো খেয়াল নেই। ঘুমাতে আসলে ঠিকি আবার ছেলেমেয়ের গা থেকে কাথা নিয়ে যায়। সায়রা বেগমের এখন উঠতে হবে, মোরগ বাগ দেয়া শুরু করেছে, মুরগীগুলাকে ছাড়তে হবে, হাঁসগুলোও একটু পর চেঁচামেচি শুরু করবে। ধান ভানতে হবে। সব এক হাতের কাজ। তার ওপর দুইদিন ধরে নামাজ কাজা যাচ্ছে।
সায়রা উঠতে গেলো। আলাল নড়াচড়া পেয়ে ঘুমের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো মাকে। আলাল-দুলাল পিঠাপিঠি ভাই। একজনের বয়স ৭, অন্যজনের ৯ তে পড়বে সামনে। একজনকে পেটে নিয়ে অন্যজনকে দুধ খাইয়েছে। ছোটবেলা থেকেই দুইটা মানিকজোড়ের মত সায়রার পিছনেই লেগে আছে, আলালকে মৃদু স্বরে ধমক দিয়ে দুলালের দিকে সরিয়ে দিল সায়রা। জালালকে উঠাতে হবে আরেকটু পরে। সায়রা বেগম তার শাড়িটা ঠিক করে বেরিয়ে এলো।
এখনো আলো ফুটে নি। একটু দূরেই পুকুর, সেখানেই ধোয়ামোছার ব্যবস্থা। শীতের রাতে পুকুরের পানি বরফ হয়ে থাকে। এসব ভাবলে চলবে কেন? সে লোহার বালতি নিয়ে পুকুরের দিকে গেলো। গরুগুলোকে খাবার-পানি দিতে হবে। পুকুরঘাটে যেয়ে তার একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। ভিটা থেকে কয়েক কদম হাটলেই পুকুর, অথচ মনে হয় কতদূরে না যেন চলে এসেছে। চারদিকে বরই গাছ, মেহগনি আর আমগাছের সারি। এরমধ্যে শুনেছে আমগাছে নাকি কয়েকদিন আগে পেত্নী দেখা গেছে। সে আম খাচ্ছে বসে বসে। এমন কি আমের আটিও ছুড়ে মেরেছে ওই বাড়ির কদম আলীর দিকে। আমগাছটা ঘাটের পাশে। সায়রা বেগম কাঠের বাধানো ঘাটের দিকে এগিয়ে যায়। রাতের ফুরিয়ে যাওয়া জোছনা তখনো পুরোপুরি শেষ হয় নি। ঘাটের ওপরে আমপাতার চিরল বিরল ছায়া পড়েছে। এরমধ্যেই সে দেখতে পেল, ঘাটের ওপরে কেউ যেন উবু হয়ে বসে উজু করছে। সায়রা বেগম জানে এই সময়ে ঘাটে কারো আসার কথা নয়। এই শীতের ভোরে বাড়ির কেউ ওঠে না। ওই বাড়ির রহিমা আসতো, সে কয়েকদিন আগে কলেরায় মারা গেছে।
সায়রা বেগম দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলো। ঘাটে যে বসে আছে সে মহিলা, মাথায় সাদা কাপড় দেয়া, মুখ দেখা যাচ্ছে না। তার মাথা ঝুকে আছ। সায়রা বেগম বুঝতে পারলো না সে কি করবে। শুনেছে লোহার আওয়াজে শয়তান পালায়। সে বালতিটা নাড়লো। মহিলাটি ফিরে তাকালো। যা ভেবেছিল তাই। রহিমাকেই দেখা যাচ্ছে। মুখ ফ্যাকাসে, চোখের কোটর যেন আগুন। রহিমা তড়িঘড়ি করে সায়রার দিকে আসতে গেলো। কিন্তু পুকুর যেন তাকে টেনে নিল। সায়রা এগোতে গিয়েও এগোলো না। তবে তার মাথা ঘুরতে শুরু করলো। সে বালতি হাতেই মাটিতে শুয়ে পড়লো। তখন ফজরের আজান পড়ছে।
২
সায়রা বেগমের জ্ঞান ফিরলো দুপুরে। বড় ছেলে জালাল তার পাশে বসে আছে। আলাল-দুলাল তারস্বরে চিৎকার করছে। আর পাশের ভিটা-বাড়ির সব মহিলারা এসে ভীড় করেছে। সায়রা বেগমের চোখ মেলতে দেখে পাশের ঘরের জয়গুন এগিয়ে গেলো। ‘ অই মাতারি, কি হইছিল? সায়রা বলে, এই ছেমড়া দুইটারে বাইরে নাও। এত চিল্লাস কেন হারামজাদারা? আলাল-দুলাল মায়ের ধমক শুনে তেমন বিচলিত হল না। একজন কান্নাও শুরু করলো।
জালাল বললো, মা আপনের কি হইছিল?
‘ শয়তান দেখছি রে। ওই বাড়ির রহিমা, কি চউখ, কি মুখ। অজু করতাছিল। ‘আরে কি কও’ ঘরের সবাই সায়রার দিকে এগিয়ে এলো। এখন সব নীরব। আলাল-দুলালও চুপ হলো। তবে দুলাল মাঝে মাঝে বলতে লাগলো, শয়তান, শয়তান। তারপর সায়রা সবিস্তারে বর্ণনা করলো কিভাবে রহিমা তার ঘাড় মটকে ধরেছিল, এমনকি চুল ধরেও ঝাকি দিয়েছে। পরে সে রহিমাকে লোহার বালতি দিয়ে কঠিন মার দিয়েছে। এরপরই তার কিছু মনে নেই। সায়রার ঘাড়ের কাছে ক্ষতের দাগও পাওয়া গেল, উপস্থিত শ্রোতাদের কাছে মনে হল চুলগুলোও ছেড়া মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই রহিমার কাজ।
রহিমার মেয়ে আছমাও ভীড়ের মধ্যে উপস্থিত ছিল, সে ভয়ে নীল হয়ে গেলো। জয়গুন তাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “কিপটার গুস্টি তরা। মরছে, আর কবর দিছস কাম হইয়া গেছে। দেখ, কলেরায় মইরা শয়তান হয়। তর বাপরে ক মোল্লা আনতে।” আছমা একমত হল। সামনেই চল্লিশা করার কথা তবে মায়ের কান্ড দেখে আর বসে থাকা যাচ্ছে না।
সায়রা হুট করে বমি করা শুরু করলো। আশেপাশে ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। অনেকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। জয়গুণ ‘ওমা, আমার মাতা গুরায়’ বলে তাড়াতাড়ি পালালো। রইলো শুধু আছমা আর জালাল। আছমা সায়রার মাথা ধরে বসে রইলো। সায়রা বমি করতে করতেই বুঝতে পারলো, সে গর্ভবতী।
৩
সায়রার শাশুড়ী মইফুলী বেগম চোখে দেখেন না। তিনি থাকেন পাশেই তার বড় ছেলের ঘরে। সায়রার পেটের খবর শুনে তিনি একচোট গালি দিয়ে গেলেন। ‘ হারামজাদা কই রে, কই রে হারামজাদা’। সায়রা তখন তোলা উনুনে রান্না করছিল, সে পেয়াজ কাটতে কাটতে বিরক্ত হয়ে বললো, আফনের পোলা এহানে নাই।
‘ তাইলে তোর পেট বাধলো কেম্নে?
‘ আউলা কতা কইবেন না। মউফুলী বেগম আরো কিছু বলতেন। তবে এর মধ্যেই মইজুদ্দীর গলা শোনা গেল। সে অবশেষে ফিরেছে। ‘আম্মাজান’ বলে সে ডাক দিলো। মইফুলী এদিক ওদিকে মাথা ঘুরালেন। কই ফিরে গালি দেবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। মইজুদ্দী তাকে পিছন থেকে ধরে বললো, আম্মা আহেন, বহেন। সায়রা তার স্বামীকে দেখলো, তবে কিছু বললো না। তার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। পেয়াজের ঝাজ বেশি করে লাগছে। আলাল-দুলাল-জালালকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। রমিলা জ্বরে ভুগছে। সে বিছানায় শুয়ে কান্নাকাটি করছে। রমিলার জন্য সাগু বানাতে হবে।
সে দেখলো মইজুদ্দী আর মইফুলী ঘরের বারান্দায় বসে আছে। পাশের ঘর থেকে তার জা জয়গুণ বের হয়ে এলো। মইজুদ্দীকে দেখে তার এত খুশি কেন কে জানে। তারা কি বলছে সায়রা জানে। সে রান্নায় মন দিলো। রাতের আগে মইজুদ্দীকে পাওয়া যাবে না। মইফুলী বেগম তার যাবতীয় অভিযোগ নিয়ে বসেছেন। কিভাবে গত পরশু একখানা হাঁসের ডিম চেয়েছিল ভেজে খাবার জন্য সেটা সায়রা বেগম দেয় নি, ভেজে না দিলেও হত, ডিমটা দিলেও হত। তাও দেয় নি। তার ওপর গরুর এত দুধ হয় মনে হয় দুই বালতি, শেষে দেখা যায় এক বালতি। বাকি এক বালতি নিশ্চয়ই সায়রা বিক্রি করে। হাওলাদার বাড়ির মেয়ে বিয়ে করায়ে এত ভুগতে হবে কে জানতো। এর ওপর শোনা যাচ্ছে পেট বাধিয়েছে। তা মইজুদ্দি তো ঘরে থাকে না। কার কাছে যেয়ে পেটটা বাধানো হয়েছে শুনি। এরমধ্যে বড় ছেলেকে আবার স্কুলে দিয়েছে। গরুগুলো সারাদিন না খেয়ে থাকে, সায়রা কখন খড়-ভুষি দেয় ঠিক নেই, তো জালালকে গরুর কাজে লাগালে তো হত। স্কুলে দেয়া লাগবে কেন? তার ছেলেদের কি জমি-জিরাত কম। তিন পুরুষ বসে খেতে পারবে না? ছেলেকে সাহেব বানিয়ে শহরে পাঠাতে চায় কেন?
সায়রা একটু একটু শোনে মইফুলীর অভিযোগ। তার মাথা ব্যথা বেড়ে গিয়েছে। তবুও সে সাগু তৈরি করে ঘরের মধ্যে রমিলাকে খাওয়াতে চলে গেলো। মেয়েটার বয়স ৫, এত রোগা হয়েছে। সায়রার মনে হয়, এই মেয়েটা মরে গেলেও হয়। মেয়ে মানুষের আর বেঁচে থেকে কাজ কি? সেই তো আরেক বাড়ির বান্দী হয়েই জীবন কাটাতে হবে। সে রমিলার পাশে সাগুর বাটিটা রাখলো। তারপর রামধমক দিয়ে বললো, কানবি না ছেমড়ি। রমিলার মুখে চামচ দিয়ে সাগু গুজে দিতে লাগলো। রমিলা গপগপ করে খাচ্ছে।
৪
মইজুদ্দি ঘরে আসলো গভীর রাতে। তখন বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে। আলাল-দুলালকে আজ জালালের সাথে শুতে দিয়েছে সায়রা। মেয়ে রমিলাকে পাশে নিয়ে চোখ মুদে আছে সে। মইজুদ্দী এসেই গালিগালাজ শুরু করলো। সায়রা বুঝতে পারলো, আবার তাড়ি গিলে এসেছে। সে কিছু বললো না। তার সকালে উঠতে হবে। মইজুদ্দীর গলা একটু পর নরম হয়ে এলো। সায়রার কাছে এসে সে মিন মিন করে বললো, বউ তর কাছে টেকা আছে? সায়রা ঘুমের ভান করে পড়ে রইলো। এবার মইজুদ্দী তার কোমরে লাথি দিল। সায়রা ব্যথায় ককিয়ে উঠে বসলো। ‘ কথা কস না কে? টেকা আছে?
সায়রা বললো, নাই। আফনে আমারে লাথি দেন কে?
‘ তো দিমু না? টেকা থাকলে ক।
‘ নাই।
‘ হুনলাম, ডিম বেচছ কয়দিন আগে ছয় ডজন।
‘ পোলারে বই কিন্না দিছি। সামনে মেট্টিক দেবে পোলা। ছারেরা কইছে পোলায় ভালো পারে পড়ালেহা।
মইজুদ্দী ভেঙিয়ে বললো, বই কিন্না দিছি। এত পড়ালেহা করাইয়া কি করবি পোলা? সাহেব বানাইবি?
সায়রা বললো, আফনের মত বানাইতে চাই না এইডা জানি। মইজুদ্দী এবার সায়েরার কানের নিচে দুইটা চড় লাগালো।
‘টাহা বাইর কর’।
সায়রাও দ্বিগুণ স্বরে চেঁচাতে লাগলো। ‘জমি-জমা সব খাইতাছে, পোলারা খাইব কি? আফনের ভাইরে আফনে কয়দিন আগে জাগা লিখ্যা দিছেন নি? দিছেন ক্যা?
‘ ওই আমার ভাইরে নিয়া কতা কছ তুই। আমার ফেরেশতার লাহান ভাইরে লইয়া কতা কছ। আমার ভাই খাইয়া বাচলে আমি খামু।
‘ হয়, আমরা মাডি খামু। আর হগল খাইব জয়গুন আর হের ভাতারে। প্রবল বিগ্রহ উপস্থিত হল। জয়গুণ, মইফুলী এই রাতের বেলায় সায়রার ঘরে চলে আসলো। ঝগড়ার বিষয়বস্তু শুনে তারা অত্যন্ত রুষ্ট হলো।
মইফুলী রায় দিলেন, সায়রা ভাইদের মধ্যে একটা বিরোধ তৈরির চেষ্টা করছে। যদি জয়গুনের স্বামী আইজুদ্দীকে দুই বিঘা লিখেই দেয় তাহলে সমস্যা কি? তাছাড়া মইজুদ্দী রং করে বেড়াতে ভালোবাসে, রং করলে কি সংসার চলবে? সাতপুরুষের ভিটা তো গরু-ছাগলে লুটে পুটে খাবে। মেয়েমানুষের ভাইদের ব্যাপারে ঢোকা ঠিক না। তবে সায়রা এই রায় মানলো না। সে জয়গুণ আর মইফুলীকে একচোট গালি দিয়ে দিলো এবং মইজুদ্দীর হাতে মার খেয়ে সকাল পর্যন্ত বেহুশ হয়ে পড়ে রইলো।
৫
জালাল মেট্রিক পাশ করলো। ফুলপুর গ্রামে জালালই প্রথম মেট্রিক পাশ। পাশের গ্রামের স্কুলে থেকে পড়াশোনা করে, দৈনিক তিন মাইল হেটে জালালের এই অর্জন। সায়রা রেজাল্টের খবর শুনে জালালকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মইফুলীও ঘর থেকে লাঠিতে ভর দিয়ে বের হয়ে এলেন। ফোকলা দাতে হাসতে হাসতে বললেন, আমার নাতি সোনার চানরে একটু দেহি। জালাল তার দাদীর পায়ে ধরে সালাম করলো। মইফুলীর অন্ধ চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। জালাল বুঝতে পারলো না, কয়েকদিন আগেই দাদী রুস্ট ছিলেন সে গরুদের কাজে ঠিকঠাক সময় দিচ্ছে না বলে, আজ পাশের কথা শুনে এত আনন্দ কেন। যদিও জালাল পড়াশোনার পাশাপাশি মায়ের সব কাজেই সাহায্য করেছে তবুও দাদীর এই আকস্মিক স্নেহ তার কাছে অদ্ভুত লাগলো। সে বললো, দোয়া কইরেন দাদি। মইফুলী তার আচলের খুটা থেকে অনেক কষ্ট করে একটা একশ টাকার দলানো মোচড়ানো নোট বের করলেন। তারপর জালালের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, কিছু কিন্না খাইও ভাই। সায়রা ঘনঘন চোখ মুছতে লাগলো। এর মধ্যেই আশেপাশের গ্রাম থেকে মানুষজন আসতে লাগলো জালালকে দেখবে বলে। পাঠক, এই গল্প সত্তর দশকের বাস্তবতায় লেখা। তাই জালাল প্রথম মেট্রিক পাশ হিসেবে একখানা বিসিএস ক্যাডারের সম্মান পেয়ে গেলো। এই অর্জনের উপহারস্বরূপ তার বাবা সেদিন তার বখাটে বন্ধুদের সাথে তাড়ি খেতে গেলেন না। ঘরেই থাকলেন।
সায়রা গরুগুলোকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে গেলো বাড়ির পাশের মাঠে। খুটা বেঁধে চলে এলো মুরগীর খোপের কাছে। এরমধ্যে দুইটা মুরগীর গায়ে ওম এসেছে। তারা ডিম দেয়া বন্ধ করেছে। খোপের মধ্যে বসে রাগী স্বরে কক্ কক্ করা ছাড়া তাদের আপাতত কোনো কাজ নেই। তারা নিজেদের ডিম খুজছে তা দেবার জন্য৷ ডিম নেই, সায়েরা ছেলেকে শহরে পাঠানোর জন্য বেঁচে দিয়েছে। মা হাঁসগুলো এখনো ডিম দেয়া বন্ধ করে নি, অতি সত্বর তাদের গায়েও ওম চলে আসবে। তখন ডিম কোথা থেকে পাবে ভাবলো সায়েরা। গরুর দুধ দোয়ানোর সময় এখন জয়গুণ কাছে কাছে থাকে, দুই বালতি হলে দুই বালতিই। সরিয়ে আলাদা ভাবে বিক্রি করার সুযোগ নেই। আগে আলাল-দুলাল-রমিলার জন্য একটু বেশি দুধ রাখা যেত, এখন সেটাও হচ্ছে না। সে নিজেও ভরা পোয়াতি, শরীর খাবার চায়। দুধ, ডিম সবকিছুই আসা আপাতত বন্ধ হয়ে যাবে কিছুদিনের জন্য। তখন জালালকে কিভাবে টাকা দেবে সেটা ভাবে সায়রা। আলাল-দুলালকেও স্কুলে দিয়েছে, তাদের অবশ্য জালালের মত আগ্রহ নেই, তবুও নতুন খাতা, নতুন বই চাই। সায়রার মাথা ঘুরতে থাকে। সে মুরগীর খোপের পাশেই বসে পড়ে। মুরগীগুলো কক কক করে ওঠে। তার মনে পড়ে ১০ বছর বয়সে বিয়ের সেই স্মৃতি। কে যেন তাকে বলে গেল, ওই পাঞ্জাবি পরা একটা লোক তার স্বামী হয়ে গেছে। সে তখন বুঝতো না স্বামী কি।সে শুধু জানতো এখন ওই লোকের বাড়ি গিয়ে থাকতে হবে, নিত্য সকালে উঠে ঝাড়ু দিতে হবে, চুলা জ্বালাতে হবে, গোবর লেপতে হবে। ভুল হলে শাশুড়ী অনেক বকবে, স্বামী মারবে। তার দাদী নূরবানু বলত,
” ও মাইয়া দুধের সর,
কেম্নে করবি পরের ঘর
পরের পুতে মারিবে,
ধরিবে গাছতলায় বসিয়া কান্দিবে।”
নূরবানুর চেহারা মনে পড়ে না সায়রার। সবি এখন ঝাপসা। শুধু মনে পড়ে দাদী মারা যাবার দিন অনেক বৃষ্টি হয়েছিল। সে স্বপ্নও দেখেছিল দাদী এসে বলছে, “আমারে যে বিষ্টির মইদ্যে তোরা মাডির তলে হালাইয়া থুইলি, এইডা তোগো কেমন বিচার।” সেই স্বপ্ন দেখে সায়রা ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠেছিল। তখন থেকেই সায়রা নামাজ পরা শুরু করে। তবু কি লাভ হল? স্বামী জুটলো মাতাল, কখন আসে, কখন যায়, কি করে সেসব কিছুই সে জানে না। লোকমুখে শুধু খবর পায়, তাদের উত্তরপাড়ার জমি বিক্রি হয়ে গেছে, পুকুর পাড়ের ভিটা জমিরুদ্দিন কিনে নিয়েছে, আমবাগান জসীম তালুকদার নিয়ে নিয়েছে। সায়রার ভয় লাগে। অনেক ভয়। সে শুনেছে লেখাপড়া করলে বড় চাকরি পাওয়া যায়, অনেক বেতন পাওয়া যায়। তাই সে ছেলেদের পড়াতে চায়।
সায়রা ভাবে জালাল একদিন বড় চাকরি পাবে। আলাল-দুলালও পড়াশোনা করে চাকরি নেবে। তখন আর মইজুদ্দী কি করছে না করছে ভেবে তার আর চিন্তা করতে হবে না। দুপুরের রোদ তাতিয়ে এসেছে। সায়রা তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে। রান্না চড়াতে হবে। এতক্ষণে জয়গুণ রান্না চড়িয়ে দিলে বিপদ। ভাত নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। খড়ির দুটি চুলার মধ্যে একটা ভেঙে গেছে। সেই চুলা লেপেও ঠিক করা হচ্ছে না। সায়রার শরীরটা খারাপ আর জয়গুণ সবসময়েই কাজ থেকে পালাতে পারলেই বাঁচে। দুপুরের রোদে অন্ত:সত্তা সায়রা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটতে থাকে। রোদে তার বিশাল ছায়া পড়ে। এই চলা অবিরাম। আবহমান বাংলার নারীদের জীবন, জীবিকা, দাসত্ব এবং স্বপ্ন একই সাথে চলে বেড়াচ্ছে যুগের পর যুগ। এই নারীরা জানে না তার শরীর কি, তার গন্তব্য কি, কেন নিত্য নতুন সত্তা তার সাথে যোগ হয় এবং কেনই বা তাদের ভারবহন করতে করতে ক্লান্ত হতে হয়। তবুও এটাই জীবন।