(মালিহা নবনীকে)
নীলক্ষেত মোড় পার হয়ে পলাশীর রাস্তায় ঢুকতেই নবনী দেখে রাস্তার পাশে জবাই করা মুরগির চটপটানোর মতো ছিঁচকে আসা কালচে লাল রঙের রক্ত। মুহুর্তেই চোখ আরেকটু সামনে নিতেই দেখতে পায় কালো,চামড়া কুঁচকে যাওয়া,ফ্যাকাশে পা থেকে রক্ত ঝরছে। লোকটা কেটে যাওয়া স্থান একটা নোংরা চেকচেক প্রিন্টের লুঙ্গির টুকরো দিয়ে বেঁধে বসে আছে রাস্তার ধারে। নবনীর চোখ চলে গেল তার পুরানো শার্টের সেলাই খুলে যাওয়া পকেটের ভিতর রাখা একটা গুটানো পলিথিন রেখে বয়স্ক চোখ জোড়ার দিকে,যেন চোখের ভিতর থেকে একটা পিতৃ সুলভ দুঃখ উপচিয়ে পড়ছে। একটু পর আবার পায়ের দিকে নজর দিতেই দেখতে পেল এই অবস্থায়ও পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন তিনি। অন্তত এইটুকু ঘটনা তৎক্ষনাৎ তাকে কান্নায় ভেঙে পড়া থেকে রক্ষা করেছে এই শহর থেকে।তারপর সে পা বাড়ালো আজিমপুর কলোনির দিকে।রাস্তায় হাঁটার সময় অধিকাংশ সময়েই কাটে তার দু’পাশের দেয়ালে তাকিয়ে তাকিয়ে। হামিস স্যার ইংরেজি পড়ান পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত,সমস্যায় পরিপূর্ণ পৃথিবীতেও বিবিধ সুবিধা নিয়ে এখন কেবল তস্কন ছাত্রী নিবাসেই সিট খালি আছে, বাসাভাড়া দেয়া হবে ছোট ফ্যামিলিকে কিংবা বাসায় গিয়ে পড়াতে চাই টাইপ কোনো লেখা। নবনীর বোধহয় সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে ট্রাভিস বিকলকে কোনো কারণ ছাড়াই আজিমপুরের গলিতে হাঁটতে হাঁটতে। বৃষ্টি আসবে আসবে এমন সন্ধ্যায় নিজেকে তার মনে হয় মরে যাওয়া শীম গাছের মতো,মরে যাওয়ার পরও কঞ্চি পেঁচিয়ে থাকছে সে কোনোভাবে, পলাশীর রাস্তাটুকু পার হতে হতে মৌসুমের শেষ শীমের মতো শুকিয়ে যাচ্ছে যেন তার নিজের মন। পলাশী কলোনির খোলা ডাস্টবিন থেকে ঝড়ো হাওয়ায় মুরগির পালক উড়ে যাচ্ছে শতাব্দী থেকে শতাব্দী ধরে বিষন্ন পথচারীদের ঘাড়ের রগে টগবগিয়ে উঠা দুশ্চিন্তাগুলো নিয়ে। কয়েকটা কুকুর দৌড়ে যাচ্ছে তাদের অনন্ত ক্ষুধা নিয়ে। ধুলায় আশেপাশের লোকজন খানিক চোখবুঁজে একরকম স্ট্যাচু হয়ে নিজ নিজ দেহটার সাময়িক দফারফা করে নিয়ে আসন্ন বৃষ্টির জঞ্জাট সামলিয়ে নিল।ঝিরিঝিরি ঠাণ্ডা বাতাস নিয়ে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে।বৃষ্টি ঝরছে অথবা পড়ছে। পড়ছে অথবা ঝরছে।মনে হলো আরেকবার ট্রাভিস বিকল তার মনে আসছে।সে দৌড়ে মোড়ের মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে আছে ট্রাফিক পুলিশদের সাথে, আরো কয়েকজনও বৃষ্টি থেকে বাঁচতে তাদের সাথে এসে দাঁড়িয়েছে।নবনী টোটব্যাগটা জড়িয়ে ধরে চারপাশে তাকিয়ে দেখল অবেলায় বৃষ্টি নামলেও যেন মানুষের চোখেমুখে আজ বিরক্তির আবহটা কম।ঢাকায় অল্প কিছুদিন হলো নবনীর। এখনো রাস্তায় বের হলে বিস্ময় চোখে নিয়ে হাঁটে যেন। ক্লাস শেষে ফেরার পথে এই একই চেনা রাস্তাটুকু যেন নিত্য ব্যস্ততায় আর মানুষের আনাগোনায় পরিবর্তিত হয়ে অচেনা হয়ে যায়। তবু তার এই অল্পকিছু দিনের গল্প নেহাৎ কম নয়। সে বরাবরই একজন স্টোরি টেলার,যেকোনো কিছুই তার কাছে ধরা দেয় এমন করে যেন স্কুলের পরীক্ষায় অফুরন্ত সময় থাকা বাংলা দ্বিতীয় পত্রের মনের মাধুরি মিশিয়ে রচনা লেখার মতো। এখন সে লেখে না,কিন্তু লেখার মাধুরিটুকু বড় হয়ে সম্পূর্ণ ভাবে ট্রান্সফার হয়ে এসেছে তার কথায়। সে যখন তার বন্ধুদের কাছে অকস্মাৎ ঘুমঘুম ভোরে হাত থেকে মনের ভুলে পড়ে ভেঙে যাওয়া ডিমের কথা বলে তার জীবন কতটা সমস্যাপূর্ণ এই বর্ণণা দেয়,তখন আমরা বুঝতে পারি বাংলা রচনায় সে নিশ্চয় খুব ভালো নাম্বার পেত।বৃষ্টি থেমেছে একবারে সন্ধ্যা নামিয়ে, মাগরিবের আজান ভেসে আসছে। রাস্তার ওপারেই মসজিদ। আজানের সুরে বৃষ্টির চেয়েও বেশি বিষাদের বর্ষণ খানিকক্ষণ যেন সবগুলো মানুষকে একটা গুমোট পরিবেশে নিয়ে আসলো। সেও অনেকদিন পর আজানটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো। কখন যে কয়েকটা বাস এসে হাঁস ছানার মতো করে দাঁড়িয়ে ভিজিয়ে নিল নিজেদের এতক্ষণ! বৃষ্টি থামার সাথে সাথে যাত্রীদের নামা-উঠার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলে বিষয়টা সে খেয়াল করলো। নবনী রাস্তাটা ক্রস করে পশ্চিম পাশে এসে একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ালো। খালাকে একটা চা দিতে বলে পাশের বেঞ্চের একটা দিকের বৃষ্টির পানি হাত দিয়ে ঝেড়ে-মুছে বসে পড়লো।সে জানে খালা কানে কম শোনে। একবার বলার পর কখনো চা দিবেন না। একবার চা চেয়ে বসে খানিকক্ষণ গল্প করে তবেই আবার গিয়ে, ‘খালা,চা-টাতো দিলেন না!’ বলার পর খালা পাশের ছেলেটাকে বলবে, ‘আরেকনা চা দে না’। তারপর চা পাওয়ার কিছুটা সম্ভবনা নিয়ে আবার আরেকটু ঝিমিয়ে নিলে তার কিছুক্ষণ পর চা পাওয়া যায়। খালার দোকানে শেখ হাসিনার একটা ছবি টাঙানো। প্রথমে নবনী ভেবেছে হয়তো মুজিবের প্রতি মানুষের ভালোবাসার মতোন খালাও প্রধানমন্ত্রীর একনিষ্ঠ সমর্থক। কিন্তু একদিন এক কাস্টমারের সাথে ঝামেলার সময় খালা যখন বলল,’ সরকারি কলোনির সামনে আমি দোহান দিছি,বিল্ডিং কি তোর বাপের? ‘সেদিন থেকেই সে বুঝতে পারল জীবনের অনেক কিছুর সাথেই পলিটিক্স জড়িয়ে আছে,ভিন্ন ভিন্নভাবে। একটু পর নবনীকে চা দিয়ে গেল। নবনী চা নিয়ে আবার চারপাশে দেখতে লাগলো।যদিও সন্ধ্যা, যদিও মন বিক্ষিপ্ত, যদিও আজ বড় উদাসীনতা জেঁকে বসেছে তাকে,তবু এইখানে ভালো লাগছে তার। চায়ের দোকানের সাথেই বড় ছাতার নিচে বসে আছে মুছিওয়ালা,নবনীর সাথে চোখে চোখ পড়ে গেল। সে এখানে প্রায়ই বসে। এখানেই তার প্রেম শুরু হয়েছে,ঝামেলা মিটেছে,বিরহ থেমেছে।কখনো কখনো বন্ধুদের কাছে হঠাৎ দেখাদেখিও হয়ে গেছে। প্রেমিকসহ এখানে তাকে তাই হয়তো সবসময়ই দেখে মুছি। কিন্তু নবনী তখন বোধহয় কোথাও তাকাতো না বলে চোখাচোখি হয়নি।নবনী মনে মনে হাসলো। কাল নিশ্চয় অনেক জোড়া জুতা আসবে মুছির কাছে।ফুডপাণ্ডার এক ডেলিভারিম্যান এসে দাঁড়াল নবনীর সামনে। এমন বৃষ্টিতে কারো হয়তো আজ রান্না করতে ইচ্ছে করছে না। নবনীরও মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেনা,তখন সে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বাড়ির কথা মনে করে একটা লম্বা ঘুম দেয়। হঠাৎ তার পাশে খানিক আগে ঠিকানা বাস থেকে নামা যে লোকটার দিকে একবার সে আনমনে তাকিয়েছিল সে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘এতিমখানাটা কী পিছনে ফেলে এসেছি? ‘আগে থেকেই তাকিয়ে ছিল বলে আর পুনশ্চ না ভেবে বলল, ‘হ্যাঁ, আপনি তো ওখানেই নামতে পারতেন।বাস ওখানেও থামায়। ‘এটা বলার পর লোকটা হাবাগোবা ধরনের একটা হাসি দিয়ে বলল,’আমি ওখানেই থাকতাম।মানে আপনাকে প্রশ্নটা হুট করেই করে ফেললাম,করতে চাইনি। কেন যে,আমি এই কয়েকবছর হলো ঢাকার বাহিরে। ‘নবনী খামোকা একটা বেহুদা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে নিজের ভাবনার আয়েশ ভঙ্গ করার বিরক্তি নিয়ে বলল’,আচ্ছা, ঠিক আছে। ‘দেখল লোকটা খালাকে চা দিতে বলে নবনীর পাশে বেঞ্চে বসে রইল চুপচাপ। সে একবার ভাবল উঠে যাবে। তারপর ভাবল,আরেক কাপ চা খাওয়া দরকার। সেও আরেককাপ চা চেয়ে এবার কি করা যায় ভাবতে শুরু করল।তারপর লোকটাকে কোনোকিছু না ভেবেই জিজ্ঞেস করলো, ওখানে কোথায় থাকতেন আপনি?এবার হাতদুটো সামনে এনে চাকরির ইন্টারভিউ দিচ্ছে টাইপ ভদ্রস্থতা দেখিয়ে বলল, শেখ সলিমুল্লাহ এতিমখানায় ছিলাম। ফরিদউদ্দীন সিদ্দিক উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছি। এরপর অনেকবার অনেকখানেই থাকা হয়েছে। সে আবার জিজ্ঞেস করলো,তারপর? ‘তারপর ঢাকা কলেজে পড়েছি ইকোনমিকসে। ওখান থেকেই পড়া শেষ করে এখন মুন্সীগঞ্জ থাকি। ওখানে ব্যাংকে চাকরি করি। আপনি? ‘নবনী চায়ের কাপ নেওয়া হাতই পিছনে ঘুরিয়ে বলল,’ এই যে,এই কলোনিতেই থাকি।’এখন কোথায় এসেছেন আপনি? নবনী আবার জিজ্ঞেস করলো; বিশেষত এতিমখানায় যারা বেড়ে উঠেছে,তাদের জীবন তো অন্যরকমই হওয়ার কথা,যদিও একটা বয়স পর সবাইই কমবেশি এতিমদের ক্যারেক্টেরিস্টিক পেয়ে যায়,সেই আগ্রহ থেকে। লোকটা বলল,আমার ভাইও থাকে একই এতিমখানায়।ওকে নিয়ে যাব ভাবছি। তার জন্যেই আসা।মাঝেমধ্যেই আসি।আপনার নাম কী? জামীর হাসান। আপনার? কোথায় পড়েন? নবনী। ডাকনাম নবনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। তারপর জামীর হাসান আবার বলতে থাকেন যে দুই বছর বয়সেই বাবাকে হারান তারা।তার বাবা বজ্রপাতে মারা যান বলে নানা কথা শুনতে হয়েছে নাকি তাদের,আর খুব স্বচ্ছল পরিবার না হওয়াতে তার মা তাদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন।তখন তার ছোট ভাই সদ্য জন্ম নিয়েছেন। তবে এসব কথা শুনেছেন মা নিলুফা আক্তারের কাছে। বাবার কথা মনে নেই তার। তারপর সব বলতে গিয়েও কেন জানি একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন।উঠে গিয়ে একটা সিগারেট নিয়ে আবার এসে বসলেন। এসে যেন বেকায়দায় পড়ে গেলেন,জিজ্ঞেস করলো অসুবিধা হচ্ছে না তো! নবনী না বলে আবার মনোযোগী শ্রোতা হতে চাইল। জামীর বলল,এখন আমি ছোটভাইকেও পড়াই। আরও আগেই নিয়ে যেতাম তখন সেরকম অবস্থা ছিল না।তারপর নবনীর দিকে তাকিয়ে বলল,সাড়ে সাতটার মধ্যেই যাব আমি। নবনী সময় দেখে নিল পলকেই। সাতটা বেজে ষোলো মিনিট।এরপর জামীর হাসানের প্রতি একটা নীরবতা ঘোষনা দিয়ে খেয়াল করলো সময় দেখতে গিয়ে নোটিফিকেশন এসে আছে, তার আব্বু দুইবার কল করেছে এরমধ্যে।যেখানে সময়ের সীমাবদ্ধতা, সেখানে আর একটা অজানা লোকের কথা শুনে কী হবে ভেবে সে ব্যাগ বের করে খালাকে টাকাটা দিতে উঠলো। তারপর যাওয়ার সময় জামীর হাসানকে হাসিমুখে বিদায় দিতে যাবে তখনই জামীর হাসানই উঠে বিদায় জানালো। চায়ের দোকান থেকে আধভেজা শরীর আর স্যাঁতস্যাঁতে একটা মন নিয়ে কলোনির ভিতর ঢুকলো সে।প্রথম গলির দ্বিতীয় বিল্ডিংটায় ঢুকে দারোয়ান মামাকে সালাম দিয়ে লিপ্টের বাটনে চাপ দিয়ে পাশের চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়লো। যেকোনো বাসার দারোয়ানরাই নবনীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে,তাই মামাকে সেই দায়বদ্ধতায় রেখে বাসার চাবিটা আছে কিনা দেখে নিল।লিফ্টে উঠা মাত্র ড্রাইভ মুভির কিস করার সীনটা মনে পড়ে গেল,সেখান থেকে মুজতবা আলীর শবনমের চুম্বন প্রসঙ্গ,শেষ পর্যন্ত আবার ট্রাভিস বিকলকে মনে পড়তে যাচ্ছিল যখন,তখনই নবনী মন ফিরিয়ে নিল আজিমপুর ফুটওভার ব্রিজে চুমু খাওয়া তার প্রথম প্রেমের প্রথম প্রেমিকের জন্য। বাসায় ঢুকে জামাকাপড় বদলিয়ে স্থিতু হয়ে বসে গা হেলিয়ে জিরিয়ে নিল একটু। গান শুনতে গিয়ে প্রথম যে গানটা এসেছে জগজিৎ সিংয়ের ‘তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে,ভাঙল কাঁচের আয়না.. বড়ই নষ্টালজিক গান।তৎক্ষনাৎ জগজিৎ সিংকেই প্রেমিকে রুপান্তর করে ভেঁজা চুলই বেঁধে দাঁড়ালো বারান্দায়। আবার ঝুম বৃষ্টি নামা শুরু করল অনবরত। কোথাও আবার কারো বাবা মারা যাচ্ছে, কোথাও এতিম হয়ে যাচ্ছে কোনো জামীর,কোথাও চুল বাঁধা দেখতে দেখতে ভাঙ্গছে কাঁচের আয়না।