সন্ধ্যার একটা গন্ধ আছে। অথবা ছিল। কতগুলা ধরে রাখা প্রাচীন আবেগের মত, অস্থিরতার আবছা আচ্ছন্ন নিয়ে কিছুটা বিষণ্ন আর অনেকটা ধূসর একটা গন্ধ। যেটা আমি আমাদের সেই মফস্বল শহরটাতে পেতাম। এখনো মাঝেমাঝে যদি কোনো মফস্বলে এলোমেলো ঘুরতে যাই কোনো সন্ধ্যায়, হয়ত পাই হয়ত পাইনা এই পরিচিত অপরিচিত গন্ধটা, অনেকটা ম্লান। থেকেও যেন নাই। আবার কখনো একেবারেই নাই। শহরগুলা, পাড়াগুলাই আর আগের মত নাই।
তখন কিছু স্পষ্ট সীমানা ছিল। যেমন মাগরিবের আজান ঘোষনা করত সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কবুতরের মত বাসায় ঢুকে পড় সবাই। খেলাধুলার সময় শেষ। উদ্বাস্তুর মত বেপরোয়া ঘোরাঘুরির সময় শেষ। নামাজ পড়ে বাসায় ঢুকতে হবে সেদিনের মত। বা বাসায় গিয়ে নামাজ পড়লেও হবে। আর এই সূক্ষ্ম ফাঁকটাকে কাজে লাগিয়ে নামাজ ফাঁকি দিয়ে আমি আকাশ ঘন কালোনীল হওয়া পর্যন্ত রাস্তায় থেকে যেতাম মাঝেমধ্যে। এইসব ছোটখাটো সীমানা না মানার ঘাড়ত্যাড়ামিটা আমার পুরানো। আমি একাই থাকতাম অনেকসময়। মাঝেমাঝে আরো অনেকেও থাকতো। শেষ ওভারটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। শেষ পেনাল্টিটা না নেওয়া পর্যন্ত।
আর মাঝেমধ্যে শুধু আমরা দুইজনই থাকতাম।
না, ভুল বললাম হয়ত। সন্ধ্যা মনে হয়না দিনের অন্য কোনো সময়- সকাল, বিকাল বা রাতের মত- যে সন্ধ্যা- হয়ে যাবে। সন্ধ্যা হয়ে যায় না। সন্ধ্যা একটা পরিবর্তনের যাত্রার মত। আলো আছে থেকে আলো নাই। ছায়াদের নিঃশব্দে সবকিছুর অধিকার নিয়ে নেয়া। আর সেই ছায়াভরা জটিলতায় আমি আমার নিজের ছায়াই হারিয়ে খুঁজতাম। অধিকার খোঁজার চেষ্টা করতাম রাস্তায় রাস্তায়, ইট থেকে ইটে, বালুর স্তুপে আর গাছের গোড়ায়। পরে অবশ্য জামিলই আমাকে শিখিয়েছিল কীভাবে এই ছায়ার জঞ্জাল থেকে নিজের ছায়াকে আলাদা করে চিনতে পারা যায়। অধিকার ধরে রাখতে হয়। জামিল আমাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছিল। আমি দৌড়াতে পারতাম না। জামিল আমাকে উঠে দাঁড়াতে শিখিয়েছিল। আমি মুখ ফুটে কথা বলতে পারতাম না। জামিল আমাকে কিভাবে গালি দিতে হয় শিখিয়েছিল।
এখনকার সীমারেখাগুলা আর আগের মত এত স্পষ্ট নাই। ঝাপসা অন্ধকারে হাতড়াতে হয় আন্দাজের উপর। মাঝেমাঝে অতীত আর স্বপ্ন তালগোল পাকিয়ে যায়। আমার ছায়াগুলো আমার কাছেই অচেনা মনে হয়। মাঝেমাঝে সবকিছুর অর্থ নাই হয়ে যায়। তখন খুব অস্থিরতায় পড়ে যাই। সন্ধ্যা তখন আর সূর্যের উপর নির্ভর করে আসে না। গন্ধটা এত ভারী হতে থাকে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
আমার তখন খুব বেশি জামিলের কথা মনে পড়ে। কিন্তু ওর সাথে আমার আর কখনো দেখা হয় নাই।
Department of Architecture, BUET